গোর খনন আর লাশ দাফন করে ক্লান্ত গোর খোদকরা

গাংনী প্রতিনিধি: মসজিদের মাইকের ঘোষণা অথবা অ্যাম্বুলেন্সের করুণ সুর এখন আর ঘুম ভাঙায় না গোর খোদকদের। এখন প্রতি রাত জেগে থাকতে হচ্ছে তাদের। একের পর এক গোর খনন আর লাশ দাফন করে বেশ ক্লান্ত। এদের মধ্যে কেউ প্রতিবেশী কিংবা একান্ত আপনজন। যত রাতই হোক কিংবা প্রতিকুল আবহাওয়ায় হোক সবকিছুকে উপেক্ষা করে জীবনের মায়া ত্যাগ করে লাশ দাফন করতেই হবে। আপনজন না হোক কিংবা করোনা আক্রান্ত হোক, সামাজিক দায়বদ্ধতা যেন তাদেরকে তাড়িয়ে ফেরে। এমনি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন গাংনীর গাড়াডোব ও জোরপুকুরিয়া গ্রামের গোর খোদকরা।
গাড়াডোব গ্রামের গোর খোদক ভাদু মিয়া, আবুল হোসেন ও নাজির হোসেন বলেন, প্রায় ২৫ বছর ধরে গোর খোদকের দায়িত্ব পালন করছি। এক মাসে ২১টি গোর খনন করতে হয়েছে। এখন অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলেই বুকের মধ্যে আঁতকে ওঠে। মনে হয় ওই বুঝি এলো লাশের গাড়ি। তারা বলেন, একতে লাশের ওপর মহব্বত অন্যদিকে করোনা আতঙ্ক। তবুও পালন করছি সামাজিক এই অবৈতনিক দায়িত্ব। তবে ইহকালের রোজগার নয়, পরকালে সৃষ্টিকর্তা যেন ক্ষমা করেন। ধর্মীয় এই অনুভূতি নিয়েই দায়িত্ব পালন করছি। তিনি আরও জানান, একজনের দাফন করে ফিরে আসতে না আসতেই আরেক জনের মৃত্যুর খবর! এতো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম দেখছেন গ্রামের মানুষ।
গাংনীর জোড়পুকুরিয়া গ্রামের গোর খোদক মসলেম জানান, প্রায় ২০ বছর যাবত গোর খনন করছেন। সাথে রয়েছে আরো তিনজন। এমনিতেই কেউ গোর খনন করতে চান না। গোর খননের অভিজ্ঞতা সবার থাকে না। আবার গভীররাতে গোরস্থানে সবাই যেতে চান না। তার ওপর আবার করোনা। অনেকেই ভয়ে লাশ দাফনে আসতে চান না। কে কখন খবর দিবে তার অপেক্ষা না করে রাত জেগে থাকতে হচ্ছে। কেননা, করোনা কখন কাকে নিয়ে যাবে তা কেউ জানে না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তারা গোর খননের দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা ছাড়াও সকলকেই করোনা পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেয়ার আহবান জানান।
সরেজমিনে গাংনীর গাড়াডোব ও জোড়পুকুরিয়া কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধ ৪৪টি কবর। সকলেই করোনা বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। গাড়াডোব ও জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মানুষকে করোনা পরীক্ষা করলে কয়েকশ করোনা রোগী শনাক্ত হবে। সামাজিক হেয়, হোম কোয়ারেন্টিন হওয়া ছাড়াও নানা ওজুহাত দেখিয়ে কেউ করোনা পরীক্ষা করতে চাইছেন না। ফলে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয়রা।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক লিটন হোসেন জানান, প্রতিদিন তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসা লোকজনকে করোনা টেস্টের জন্য জোর তাগিদ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। জোড়পুকুরিয়া ও আশেপাশের গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষেরই করোনা উপসর্গ আছে। পরীক্ষা করলে শতকরা ৮০জনের করোনা পজিটিভ হবে। এমনিতেই কেউ স্বীকার করে না। যখন গুরুতর অবস্থা হয় কিংবা অক্সিজেন সংকটে পড়েন তখনই জানা যায়।
গাড়াডোব গ্রামের আবু সুফিয়ান জানান, তিনি চলতি মাসের ৭ তারিখ করোনায় আক্রান্ত হন। করোনা পজিটিভ হওয়ার পর নিজবাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। ২২ জুলাই অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার পর থেকে দোকান খুলেছেন। তিনি আরও জানান, যাদের বাড়ির লোকজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অথবা আক্রান্ত তারাও কোন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। নিয়মিত বাজার করছেন। তাদেরকে নিষেধ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। করোনায় যেভাবে মানুষ মরছে তাতে কবরস্থান বাড়াতে হবে সেই সাথে গোর খোদকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ধানখোলা ইউপি চেয়ারম্যান আখেরুজ্জামান বলেন, গাড়াডোব গ্রামে এক মাসে ২১জন মারা গেছেন। স্থানীয় গোর খোদকরাই তাদের দাফন করেছেন। তবে তাদের কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান কিংবা আর্থিক সহায়তা করা হয় না। করোনা সময়কালীন সময়ে তারাও মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। তাদেরকে করোনা পরীক্ষা করা দরকার। আমাদের পরিষদ থেকে তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ নেই। তবে তারা যে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগতো। তাদের এই মানবিক কর্মকা-ে আমরা সকলেই কৃতজ্ঞ।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দীন বলেন, জ্বর ও সর্দি-কাশি যাদের হচ্ছে তারা যদি সচেতন হন, তাহলে অনেক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাদেরকে হাসপাতালে আসতে হবে, প্রয়োজনে টেস্ট করাতে হবে। পরীক্ষায় যদি কেউ পজিটিভ হন তাহলে তার সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু গোপন করলে তিনি যেমনি শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন; তেমনি তার মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে। তাই ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নেয়ার আহবান জানালেন তিনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More