তালেবানের কাছে কাবুুলের পতন : শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি

আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান
মাথাভাঙ্গা মনিটর: আফগানিস্তানে কার্যত ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে। রাজধানী কাবুলের চারদিক ঘিরে রেখেছে তারা। রাজধানীর ভেতরেও প্রবেশ করেছে। অপেক্ষা কেবল ক্ষমতা হস্তান্তরের। তালেবান সরকারকে পরাজয় স্বীকার এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেছে। এ নিয়ে আলোচনাও চলছে। গতকালই দেশ ছেড়ে তাজিকিস্তানে গেছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর প্রধান হতে পারেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি আহমাদ জালালি। তবে তালেবান নেতা মুল্লাহ বারাদারও প্রধান হতে চান। তালেবানের ভয়ে বাসিন্দাদের কাবুল ছাড়ার হিড়িক পড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কর্মীদেরও সরিয়ে নেয়া হয়। সর্বশেষ রোববার পতন হলো রাজধানী কাবুলের। এদিন মিছিল নিয়ে শোডাউন করে শহরটির চারদিক থেকে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা। এসময় রাস্তায় দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন সাধারণ মানুষ। তাদের চোখে মুখে ছিলো ভয়াতঙ্ক। আগের দিন থেকেই কাবুল ছাড়তে শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা। তবে তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘জোর করে’ ক্ষমতা দখলের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। কারও ওপর কোনো প্রতিশোধও নিতে চায় না তারা। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সাথে আলোচনা চলছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুলতে প্রায় দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেও তালেবান মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় পুরো আফগানিস্তান দখল করে নিলো। মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিন লাখের মতো। সঙ্গে রয়েছে বিমানবাহিনী। তা সত্ত্বেও তালেবানকে ঠেকাতে পারলো না আশরাফ ঘানি সরকার। তাসের ঘরের মতো ধসে পড়েছে আফগান বাহিনীর প্রতিরোধ। বেশিরভাগ শহরই অনেকটা বিনা বাধায় দখল করে নিয়েছে তালেবান।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল সাত্তার মিরজাকওয়াল বলেছেন, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতে ‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর’ করতে চাইছে ঘানি সরকার। আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেল টোলো টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিও বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আফগান জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই… কাবুলে কোনো হামলার ঘটনা ঘটবে না। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের হাতে ‘শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর’ করা হবে।
তবে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ঘানি দেশ ছেড়ে তাজিকিস্তান যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাজধানী কাবুল ছেড়েছেন তিনি। এ বিষয়ে আফগান প্রেসিডেন্ট দফতরের সাথে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, নিরাপত্তার খাতিরে তারা প্রেসিডেন্ট কী করছেন বা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে চান না। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ক্ষমতা হস্তান্তরে আলোচনা শুরু করেছে তালেবান ও ঘানি সরকার। বর্তমান সরকার ‘অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার’র হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। আর এ অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কূটনীতিক আলী আহমাদ জালালির নাম শোনা যাচ্ছে। আফগানিস্তানের হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের প্রধান আব্দুল্লাহ ক্ষমতা হস্তান্তর শুরুর প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতা করছেন। দেশটির সংবাদ সংস্থা খামা প্রেসও একই রকম তথ্য দিয়েছে। তবে সরাসরি তালেবানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে সংগঠনটির উপপ্রধান মোল্লা আব্দুলগনি বারাদার দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারেন।
কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থানকারী তালেবানের এক নেতার বরাত দিয়ে জানা যায়, রাজধানী কাবুলে যোদ্ধাদের সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে বলেছে তালেবান। কেউ শহরটি ত্যাগ করতে চাইলে, তাদের এ সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নারীদের নিরাপদে অবস্থান করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। কাবুলে তালেবানের প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিবিসির প্রতিবেদক ইয়ালদা হাকিমও। তিনি জানিয়েছেন, তালেবান যোদ্ধাদের কাবুলে তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে না।
কাবুল দখলের আগে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান শহর মাজার-ই-শরিফ দখলে নিয়েছে তালেবান। এটি আফগানিস্তানের চতুর্থ বৃহত্তম শহর এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। দেশটির বালখ প্রদেশের রাজধানী এটি। প্রেসিডেন্ট ঘানি সফর করার কয়েক দিনের মধ্যেই শহরটি আফগান সরকারি বাহিনীর হাতছাড়া হলো। এর আগে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর জালালাবাদের দখল নেয় তালেবান। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তালেবান শহরটির দখল নিতে সক্ষম হয়। জালালাবাদ দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে অন্তত ২০টির নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান তালেবানের শাসনে ছিলো। এর মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট সেখানে যৌথ অভিযান চালায়, যার মাধ্যমে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে।
তালেবানের উপ-প্রধান মোল্লা আব্দুলগনি বারাদার ঘোষণা করেছেন, তারা এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী, তবে তাদের মূল লক্ষ্য আফগানিস্তানের স্বাধীনতা। তিনি শনিবার এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন। বারাদার বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায় না। তালেবান মনে করে, আফগানিস্তানের সব শ্রেণির মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান। তিনি বলেন, ইসলামি অনুশাসনের আওতায় সব আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি, মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, নারী অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতার প্রতি তালেবান সম্মান প্রদর্শন করে। এছাড়া, তালেবান নারীর শিক্ষা, চাকরি, সম্পদের মালিকানা ও ব্যবসা করার অধিকার প্রদান করবে। আর এসব হবে ইসলামি আইন ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে। তালেবানের উপপ্রধান আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সে দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More