শতাব্দীর মহাজাগরণের মহানায়ক শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ব্যক্তিত্ব কোন পরিচিতির মুখাপেক্ষী নয়। ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে তার খেদমত ও অবদান পৃথিবীর ইতিহাসে চির সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বাহ্যিক জগতে যেমন ছিলেন রঈসুল উলামা ও মুজাহিদে আযম, ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেও তিনি ছিলেন সুলতানুল আউলিয়া ও কুতবুল আলম।
১. আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অপূর্ব সমাবেশ। একই সঙ্গে প্রায় সব সৎ গুণের অধিকারী হওয়া কোন আদম সন্তানের জন্য অসম্ভব না হলেও অন্তত বিরল নিঃসন্দেহে।
আল্লাহপাক যাকে একান্ত নিজের বানিয়ে নেন, যাকে দ্বীন ও মিল্লাতের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে নির্বাচিত করেন, এমন ব্যক্তিকেই তিনি বৈচিত্র্যময় প্রায় সব গুণাবলী দিয়ে সুশোভিত করে থাকেন।
কবির ভাষায়-
لَيْسَ عَلَى اللهِ بِمُسْتَنْكِرٍ اَنْ يَّجْمَعَ الْعَالَمَ فِىْ وَاحِدٍ
‘একই ব্যক্তির মধ্যে সব গুণের সমাহার করে দিলে আল্লাহ তাআলাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।’
বৈচিত্র্যময় প্রায় সব গুণের অধিকারী এমন মনীষীর জীবন চরিতের কোন দিকটি নিয়ে আলোচনা করবো, তা নির্ণয় করতে আমি অপারগ। তিনি একই সঙ্গে মুতাকাল্লিম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ, মুজাহিদ, সূফি, মুবাল্লিগ, আবেদ-যাহেদ, মুত্তাবিয়ে সুন্নাত ও আশেকে রাসূল ছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বদিকে পরিপূর্ণ আদর্শ মানব, সাহাবা-চরিতের ক্ষণজন্মা মনীষী।
২. উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী আলো করা আমাদের মহামান্য পীর-মুরশিদ ছিলেন এই বঙ্গদেশীয় মানুষের জন্য খোদার প্রেরিত দরদী বন্ধু, সত্যিকারের ইনসানে কামেল। এ মহান ব্যক্তি চট্রগ্রামের মাটিতে জন্ম নিলেও তার খেদমত ছিল সারা দেশব্যাপী; বরং বিশ্বব্যাপী।
চিরসত্য এই যে, এ নশ্বর জগতের বাসিন্দারা এই ক্ষণজন্মা মহামনীষীর কৃতজ্ঞতা যতই প্রকাশ করুক না কেন, সেটা তার খেদমতের পরিধির বিচারে নিতান্তই ক্ষুদ্র হবে। বর্তমানকালে বাংলাদেশের সব উলামা-মাশায়েখ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হজরতের ফয়েয-সিক্ত ও বরকতধারায় সৌভাগ্যমণ্ডিত।
আর তাদেরই মধ্যস্থতায় সারা বাংলার মুসলমানগণ ‘ফুয়ুযে আহমদী’ হতে ফয়েয সিক্ত হয়ে চলেছে এবং কিয়ামত অবধি এ ফয়েয ও বরকতের ধারা চলমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।
৩. প্রিয় শায়খের সঙ্গে আমার ‘রূহানি তা‘আল্লুক’ (আধ্যাত্মিক সম্পর্ক) ১৫ বছর ধরে সেই ২০০৫ সনের হাটহাজারীর দাওরার বছর থেকে। আর শায়খের শায়েখ হজরত শাইখুল ইসলাম মাদানী (কুদ্দিসা ছিররুহু)-এর আশেক হয়েছি তারও আগে সেই মক্তব-নাযেরায় মালিবাগ জামিআ থেকে। তো আবেগে নয়; বরং হজরতের মাকাম বুঝেই তার দারস্থ হয়েছি ইসলাহের মানসিকতা নিয়ে। আমি আমার শায়েখকে হজরত শাইখুল ইসলাম মাদানী (রহ.)-এর হুবহু নকল পেয়েছি- যতটুকু আমার মুতালাআয় ধরেছে।
হজরত শায়েখ (রহ.) আপন পীর-মুরশিদ কুতবুল আলম হজরত মাদানী (কু.ছি.)-এর লম্বা সোহবতে থেকে বিশেষ কয়েকটি গুণ নিজের মধ্যে মজবূতভাবে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে গুণাবলীর মধ্যে সবিশেষ তিনটি গুণ নিয়ে পাঠক-বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করছি।
১. তাকওয়া-পরহেযগারী : হজরত (রহ.) সবসময় ওজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতেন। শেষ রাতে যিকির ও তাহাজ্জুদে অভ্যস্থ ছিলেন। কুরআন তেলাওয়াত ও হাদিস শরীফের মুতালাআয় মগ্ন থাকতেন। সুন্নাতে রাসূল ও মাসনূন দুআগুলোর উপর পাবন্দ ছিলেন। হজরত একজন দরবেশ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি বলতেন- ‘আমি কখনো ইচ্ছায় কোনো কবীরা গুনাহ করেছি বলে আমার মনে পড়ে না।’
২. ইখলাছ ও লিল্লাহিয়্যত : এটা হজরত শায়েখ (রহ.)-এর ইখলাছ ও লিল্লাহিয়্যতেরই বহি:প্রকাশ যে, তিনি যেসব দ্বীনি কাজে হাত দিয়েছেন, সেগুলো চূড়ান্ত সফলতায় গিয়ে পৌঁছেছে। আজকের দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসা, বেফাক বোর্ড, হাইয়াতুল উলইয়া, হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে দাওয়াতে ইসলাহ, নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডসহ হজরত সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান মূলত: আমাদের প্রিয় হজরতেরই ইখলাছের পরশ পেয়ে কামিয়াব ও সফলতার চূড়ান্ত শেখরে উন্নীত হয়েছে বৈ কি?
৩. তাওয়াযূ ও বিনয় : হজরত শায়েখ (রহ.)-এর তাওয়াযূ ও বিনয় তো প্রবাদ তুল্য ও সর্বজন স্বীকৃত। তিনি এত বড় হওয়া সত্বেও নিজেকে কোন কিছুই মনে করতেন না। সব সময় নিজেকে ছোট ভাবতেন এবং নিজের কামালাত ও গুণাবলীকে লুকিয়ে রাখতেন।
এ যেন ‘আখলাকে মাদানী’র হুবহু প্রতিচ্ছবি। বিনয় ও নম্রতা তার ভূষণ ছিলো। সদা চুপ থাকতে পছন্দ করতেন। কথা বলতেন বটে; তবে হিসেব করে এবং দরকার অনুপাতে।
৪. আমি গুনাহগার সেই দাওরার বছর থেকে হজরত শায়খের অকৃত্রিম ভক্তি মিশ্রিত প্রেম-ভালোবাসা হৃদয়ের সজিবতায় ধারণ করে আসছি। কারণ, আমার কাছে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিলো তিনি আমার স্বপ্নপুরুষ আওলাদে রাসূল হজরত শাইখুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী (কু.ছি.)-এর সরাসরি ছাত্র ও ইজাযতপ্রাপ্ত খলীফা; বরং সত্য বলতে কি, তিনি ছিলেন শেষ জীবনে একমাত্র ‘জানেশীনে মাদানী’।
তাই স্বভাবগতভাবে আমি হজরত শায়খের প্রতি অপরিসীম আকৃষ্ট। আমার মন-মস্তিষ্ক, হৃদয়-আত্মায় হজরতের অনুগ্রহ-অনুকম্পা মিশে আছে।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত এ কারণে যে, আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ এই মহান মনীষীর সোহবতে ও সংশ্রবে ব্যয় হয়েছে।
তার সঙ্গে আমার ‘রূহানী নিসবত’ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় নেআমত। এই নিসবতকেই আমি আমার পরকালের মুক্তির বড় উপায় মনে করি।
হে দয়ার আধার! আপনার সমীপে এ অভাজনের একান্ত ফরিয়াদ- আমাদের পরম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার এই মহান শায়েখকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমাকে ও আমাদেরকে শায়খের বাতানো তরীকায় আজীবন অটল থাকার তাওফীক দান করুন।
উম্মতে মুসলিমাকে তার ফয়েয ও বরকত দ্বারা উপকৃত করুন। রোজ কিয়ামতে মুরশিদ হাটহাজারী ও শাইখুল ইসলাম মাদানীর সঙ্গে হাশর করুন। আমীন, ছুম্মা আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.