চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী মেটেরি মেলা দেখতে চায় এলাকাবাসী 

আষাঢ়ের ৫ দিন বাকি; আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হলেও কাটেনি ধোয়াশা

লাবলু রহমান: আর মাত্র ৫ দিন পরেই আষাঢ় মাস। ২ বছর মহামারী করোনা ভাইরাসসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিগত ৫ বছর কয়েক শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি আ¤্রবুচি মেটেরি মেলা বন্ধ রয়েছে। যাকে স্থানীয়রা জামাই বিদায় মেলা নামে জানে। ইজারাদাররা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও এ বছরও মেলা অনুষ্ঠিত হবে কি না? সেটি ধোয়াশার মধ্যে রয়েছে। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন বলছে, এলাকার জনপ্রতিনিধির সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক বরাবর মেলা শুরুর বিষয়ে আবেদন করা হয়েছে।

মেলাকেন্দ্রিক গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের ৭ তারিখ মেলা শুরু হলেও জৈষ্ঠ্যমাসে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এসে জড়ো হতেন মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে। আর মাত্র ৫ দিন পর আষাঢ় মাস শুরু হবে। তারপরও শুনশান মেলা প্রাঙ্গন। একসময় এই মেলায় কাঠের তৈরি ফার্নিচার, মনোহারী, হরেক রকমের খেলনা, মিষ্টি, বিভিন্ন হস্তশিল্প, বাচ্চাদের বাহারি খেলনা, তৈজসপত্র বিকিকিনি হতো। বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা জৈষ্ঠ্যমাসের ১৫ তারিখের পর এলাকায় জমায়েত হতেন। এছাড়াও বেচা বিক্রির পাশাপাশি বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে সার্কাস, যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শনী, বিচিত্রা, বাইক বা কার রাইড আনন্দ উপভোগ করতে যেতো। মানুষ যেটুকু উপভোগ করেছে, তা মন-প্রাণ দিয়ে করেছে। আর মেলাকেন্দ্রিক বিনোদনই ছিলো তখন সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। কালের বিবর্তনে মানুষের মন থেকে তা এখন হারাতে বসেছে।

মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তরা প্রায় সারা বছর ধরে মেলার অপেক্ষায় থাকতো। এলাকার যুব সমাজরক্ষা সামাজিকতার কারণে স্থানীয়রা মেলা বিমুখ। তবে সাধাসিধে মেলার আগ্রহের কথা জানান তারা। ঐতিহ্য রক্ষা চিত্তবিনোদনের জন্য আগের মতো জামাই বিদায় মেলা দেখতে চান। তাদের দাবি অপসংস্কৃতি নিপাত যাক, সুষ্ঠু সংস্কৃতি ফিরে পাক।

মেলার বিষয়ে কথা হয় গড়াইটুপি ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার মেটেরি মেলার ইজারা দিলে সুষ্ঠু পরিবেশে মেলা অনুষ্ঠিত হলে সমস্যা নেই। এটা বাপ দাদার আমল থেকে ঠিক যেভাবে হয়ে আসছে অর্থাৎ ৭ দিন মেলা অনুষ্ঠিত হোক। মূলকথা আমার দৃষ্টিতে আবার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে নতুন করে পথ চলবে এটাই কামনা। সাদাসিদে মেলা হলে এই মেলাটি তার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে।

মেলার সাবেক ইজারাদার ও তিতুদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শুকুর আলী জানান, আমি ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি অ¤্রবুচি মেটেরি মেলার ১১ বারের ইজারাদার। এই মেলা পশ্চিমবঙ্গের বানপুর মেটেরি মেলার সাথে একই সময় অনুষ্ঠিত হয়। মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে মেলাটি বন্ধ ছিলো। সামনে আষাঢ় মাস আসছে সরকার যদি ইজারা দেয় তাহলে আমার সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। অ¤্রবুচি হলো ৫০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খাঁন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, মেলার ইজারা সম্পর্কে আমার ভালোভাবে জানা নেই। করোনাকালীন ২ বছর মেলাটি বন্ধ থাকতে পারে কিন্তু আগের ৩ বছর কেনো বন্ধ ছিলো এ সম্পর্কে আমার ডিটেইলস জানা নেই। ইতোমধ্যে একটা দরখাস্ত জমা পড়েছে। আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যান বা সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেবো।

উল্লেখ্য, কথিত আছে হযরত মালিক উল গাউস (রা.) একজন সাধক ছিলেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গড়াইটুপি গ্রামে একটি নির্জন মাঠে আস্তানা গড়ে তোলেন। সেখান থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করতেন। এলাকায় পীর হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। সেখানে তিনি বাংলা সনের ৭ আষাঢ় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে নির্দিষ্ট কোনো সাল কেউ জানেন না। গড়াইটুপি অম্রবুচি মেলা গ্রামের মাঠের মধ্যে তার রওজা আছে। প্রতিবছর ৭ আষাঢ় হযরত খাজা মালিক উলগাউস (রা.) স্মরণে সাতদিন ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে ৫ বছর ধরে বিচারকের স্বাক্ষর জালিয়াতি, অশ্লীলতা ও নোংরামির অভিযোগে বন্ধ রয়েছে। এটি মেটেরী মেলা নামে সবার কাছে অধিক পরিচিত লাভ করেছে।

একসময় হজরত মালিক-উল-গাউস (র.) তার আস্তানা গড়ে তুলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন তা ঠিক কত সনের দিকে তার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। তবে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। বহু কালের ইতিহাস থেকে জানা যায় তার জনপ্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা গৌরগোবিন্দ তাকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। এর মধ্যে রাজার মেয়ে অম্রবুচি নিজেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এতে রাজা আরও বেশি ক্ষুদ্ধ হয় এবং তাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তার বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী দরবেশকে তার সৈন্য বাহিনী মারতে ব্যর্থ হয়, উপরন্ত রাজার সৈন্যবাহিনী মারা যায় এবং রাজার রাজপ্রাসাদ মাটির নীচে বিলীন হয়ে যায়। যার ধ্বংসাবশেষ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে অত্র ইউনিয়নের কালুপোল গ্রামে দর্শনীয় হয়ে আছে। যেটি সরকারের প্রত্নতাত্বিক অধিদফতর সংরক্ষণ কাজ শুরু করেছে। এর কিছুদিন পর দরবেশ মালিক-উল-গাউস (রঃ) ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর মালিক-উল-গাউছের শরীর সমাধি বটগাছের নিচেই করা হয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। মাজারকে কেন্দ্র করে বহু যুগ ধরে গড়াইটুপির এই মাঠে মেলা বসতো। তবে ঠিক কত বছর আগে থেকে এই মেলার যাত্রা শুরু তা অজানা সবার কাছে। কিন্তু বর্তমানে মেলাটি বন্ধ প্রায় পাঁচ বছর ধরে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে মেলাটি বসেছিলো।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সরকার মেলার স্থানটি ইজারা দিয়ে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা রাজস্ব পায়। সে হিসেবে গত ৫ বছর স্থানটি ইজারা দিতে না পেরে সরকার প্রায় আড়াই কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেই সাথে এলাকাবাসী বঞ্চিত হয়েছে বিনোদন থেকে। মেলাটির সাথে মিশে আছে চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্য। দেশের প্রায় ৪৭ জেলার মানুষের মিলন মেলায় পূর্ণ হতো বটবৃক্ষের অ¤্রাবুচি মেলার মাঠ।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More