চুয়াডাঙ্গায় নাবা জিরো ৫৫ বীজ কিনে ক্ষতির সম্মুখীন ভুট্টাচাষিরা

কৃষি কর্মকর্তাসহ বিএডিসির চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় নাবা জিরো ৫৫ বীজ ভুট্টা বীজ বপন ও বিক্রয় করে কৃষক ও রিটেইলারগণ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ভুক্তভোগী এসব কৃষকদের পক্ষে রিটেইলার গণ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক সহ বিএডিসির চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার পদ্মবিলা ও তিতুদহ ইউনিয়নের সুবদিয়া, কোটালী, পিরোজখালী, হোগলডাঙ্গা, নিমতলা, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভাধীন কুলচারা, গ্রামের ভুট্টাচাষীরা ‘নাবা ক্রপ কেয়ার লিমিটেড’ কোম্পানির সরবরাহকৃত ‘নাবা জিরো ৫৫’ জাতের ভুট্টা বীজ বপণ করে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কৃষকদের অভিযোগ, গাছে ভালোমতো শিষ আসেনি, মুসা ছোটো, দ্রুত পাতা মরে গেছে, আগে বপন করা হলেও ভুট্টা দেরিতে সংগ্রহ করতে হয়েছে। বিঘাপ্রতি আশাতিত ফলন নেই, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভুট্টা কোম্পানির কোনো কর্মকর্তা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের কোন খোঁজ খবর নেননি। কৃষকরা আরও বলেন, জমি চাষ, সার, সেচ ও শ্রম খরচসহ প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করেও এখন আমরা বিঘাপতি কোনো কোন চাষী ৫ মন ভুট্টাও ঘরে তুলতে পারেননি।
সুবদিয়া গ্রামের কৃষক মো. ইকলাস বলেন, “আমি তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলাম। গাছ হয়েছে ভালোই, কিন্তু শিষ আসেনি। প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করেছি। ফলন তো দূরের কথা, পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করার মতো কিছু পাইনি।” একই গ্রামের মো. আব্দার রহমান বলেন, “আমি দুই বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছিলাম, ক্ষেতের সব গাছ পুড়ে মরে এখন ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমাদের মতো সীমিত সামর্থ্যের কৃষকদের জন্য বড় ধাক্কা।”
কোটালী গ্রামের রিটেইলার (বিক্রয় প্রতিনিধি) মো. সেলিম উদ্দীন জানান, “বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, এটা উন্নত জাত, ফলন ভালো হবে। কৃষি অফিস থেকেও প্রদর্শনী প্লট হিসেবে বীজ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমরা প্রতারিত হয়েছি। এই বীজে কোনো ফলনই আসেনি।” কৃষকদের কাছে আমরা বাকিতে বিষ বিক্রি করেছিলাম। এখন তারা কিভাবে আমাদের বীজের টাকা দিবে। বীজের টাকা তো দূরের কথা, তারাই উল্টো আমাদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন। একই গ্রামের কৃষক মো. ফজলুল হক ও মোহাম্মদ আলী বলেন, “বীজ বপনের সময় আমাদের বলা হয়েছিলো যে এই জাতটি শীঘ্রই শিষ ধরে ও ভালো ফলন দিবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টা।, জমির ক্ষতি সহ আমরা অর্থ, শ্রম ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
পিরোজখালী, কুলচারা, হোগলডাঙ্গা,কুলচারা ও নিমতলা গ্রামের কৃষকেরাও জানিয়েছেন, তারা নিজেদের জমানো টাকা ও ধারদেনা করে বীজ, সার ও শ্রমের খরচ চালিয়েছেন। কিন্তু ভুট্টায় ফলন না হওয়ায় এখন আমরা ঋণ শোধ করতে পারছি না। আমরা অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম হতাশা ও দুশ্চিন্তায় আছি।
রিটেইলার (বিক্রয় প্রতিনিধি) কৃষকদের পক্ষে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক এবং বিএডিসির চেয়ারম্যান ও অর্ন্তরবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘নাবা জিরো ৫৫’ নামের ভুট্টা বীজটি নিম্নমানের, পুরাতন বীজ। যা থেকে ফলন আসেনি। ফলে কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক বিপর্যয়েও পড়তে হয়েছে। চাষিদের পক্ষে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন, কুলচারা গ্রামের ইমরান, কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বিশ্বাস ট্রেডার্স এর উজ্জ্বল বিশ্বাস, সুবদিয়া গ্রামের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. সলক হোসেন ও কোটালী গ্রামের মোহা. সেলিম উদ্দিন। তারা দাবি করেছেন, এসব ভেজাল বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ সহ লাইসেন্স বাতিল ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। পুরানো বীজ ও মানসম্মত বীজ কৃষকের না দেয়ায় আমরা ছোট হয়ে গেছি। তারা ভ্ট্টুা বিক্রি করে আমাদের বীজের দাম দিবে কিন্তু ভুট্টাতেই যখন ফলন হয়নি তখন তারাই বা কি বিক্রি করে আমাদের বীজের দাম দিবে। আমরা খুব আতঙ্কে আছি। যে কোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত ভুট্টা চাষিরা আমাদের উপর হামলা করে ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান বলেন, কোটালী এলাকার কয়েকজন রিটেইলার ইসাকদের পক্ষে অভিযোগ দিয়েছেন। সেই অভিযোগটি আমরা সরেজমিনে গিয়ে যাচাই-বাছাই করেছি। অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সময় লাগবে। এছাড়া সুবদিয়া এলাকায়ও এরকম কিছু অভিযোগ রিটেইলাররা কৃষকদের মাধ্যমে করিয়েছেন। “বিষয়গুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। সরেজমিনে তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
চুয়াডাঙ্গা কি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, আমি বিষয়টি জেনেছি। আরো জেনেছি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বরাবর কৃষকদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন রিটেইলার অভিযোগ দাখিল করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন কৃষক সরাসরি অভিযোগ দাখিল করেনি। যদি সত্যি সত্যিই বীজের কারণে ভুট্টার ফলন না হয় সে ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তো কৃষকরা হবে। আর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করে কৃষকদেরকেই কোম্পানির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
এ বিষয়ে নাবা জিরো-৫৫ ক্রপ কেয়ার লিমিটেডনকোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমাদের কোম্পানির চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কোটালীগ্রামের সেলিম উদ্দিন ও এলাকার কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রায় এক কোটি টাকার বিক্রয় করেছে। এরমধ্যে খোঁজখবর নিয়েছি বেশ কিছু কৃষক তাদের আশাতীত ফলাফল (ফলন) পেয়েছেন। তবে এ কথা সত্য চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ভুট্টা সমৃদ্ধ এলাকায় গত বছর থেকে এক ধরনের ভুট্টার রোগের সৃষ্টি হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় সেই রোগের কারণেও হয়তো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এ বিষয়ে আমরা আমাদের মার্কেটিং অফিসারের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়েছি। তবে একটি বিষয় আমি ক্লিয়ার করতে চাই, যে সকল রিটেইলারগণ (বীজ বিক্রয় প্রতিনিধিগণ) কোম্পানির নিকট থেকে শর্তসাপেক্ষে বীজ গ্রহণ করে কৃষকদের মাঝে বিক্রয় করেছেন। তারা আমাদের বীজের বকেয়া টাকা পরিশোধ না করার জন্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে কি-না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে কৃষকরা বলছেন, এমন হলে এ এলাকার কৃষকদের ভুট্টা চাষের উপর যেমন আস্থা হারাবে, তেমনি ভুট্টা বীজ কোম্পানির উপরেও বিশ্বাস হারাবে। আমাদের কৃষি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বীজ অনুমোদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় কঠোর নজরদারির দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সলোক, ইমরান ও উজ্জ্বল বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, আমরা সরল বিশ্বাসে কোম্পানির নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা পেমেন্ট ও চেক দিয়ে বীজ ক্রয় করেছিলাম। সেই বীজ এলাকার কৃষকদের মাঝে আমরা বিক্রয় করেছিলাম। নিম্নমানের ও মানসম্মত না হওয়ায় কৃষকরা কাঙ্খিত ফলন পায়নি। বিধায় ঐ সকল ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা আমাদের বকেয়া টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না। এদিকে কোম্পানির কর্মকর্তাদেরকে একাধিকবার ফোন করলেও তারা ফোন রিসিভ করছে না। আমরা বিক্রয় প্রতিনিধিরা পড়েছি মহা বিপদে। এই অবস্থায় সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More