জীবননগরে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে মানববন্ধনে মৎস্যজীবীরা

সালাউদ্দীন কাজল: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বেনীপুর বাওড়ের (জলমহাল) খাস আদায় বন্ধ এবং ইফাদের চুক্তি মোতাবেক আগামী ২৫ বছর নিজেদের অধীনে মাছ চাষের অনুমতিসহ ভোগদখলের নিরাপত্তা অব্যাহত রাখার দাবিতে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে মানববন্ধন করেছেন দু’শতাধিক মৎস্যজীবী। তারা বুধবার সকালে বেণীপুর বাওড়ের ধারে এবং গতকাল শনিবার দুপুরে মহেশপুর উপজেলার কুসুমপুর গ্রামের পাশে ওই বাওড়ের ধারে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে বেনীপুর বাওড় পাড়ের পাঁচ গ্রামের ১১৫ জন সুফলভোগীসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন তারা। মানববন্ধনে তারা স্লোগান দেন ‘কাফনের কাপড় মাথায় পরে নেমেছি, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবো।’
বেনীপুর বাওড় (জলমহাল) ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দীন মোহাম্মদ জানান, ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে ইউএনডিপি, ওপিএস এবং ডানিডার যৌথ পরিচালনায় আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) বাংলাদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও পশু সম্পদ (পরবর্তীতে প্রাণিসম্পদ) মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৮৯ সালের ২০ জুন বেণীপুর বাওড় ইফাদ চালিত প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইফাদ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক বেণীপুর বাওড়ের তীরবর্তী ধান্যখোলা, বেণীপুর, কুসুমপুর, স্বরূপপুর এবং পেপুলবাড়ীয়া গ্রামের দুস্থ ও ভূমিহীন ১১৫ জন সুফলভোগী মৎস্যজীবী ১৯৯৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৫০ বছরের জন্য বাওড়টি ইজারা নেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রতি ১০ বছর পরপর ইজারা নবায়ন করতে হবে। ইজারা মেয়াদের নবম বছর শেষে মৎস্য অধিদফতর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নিকট অনুরোধ জানাবেন। জেলা জলমহাল কমিটি সংশ্লিষ্ট বাওড়ে মৎস্য অধিদফতর এবং বাওড় ব্যবস্থাপনা দলের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং কর্মকান্ড পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে জেলা প্রশাসককে মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করবেন। জেলা প্রশাসক জেলা মৎস্য কর্মকর্তার নিকট বাওড় ইজারার মেয়াদ পরবর্তী দশ বছরের জন্য বৃদ্ধি করবেন। এভাবে ৫ দফায় ৫০ বছর ইজারা মেয়াদ বহাল থাকবে। ১৯৯৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইজারা নেবার পর থেকে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী সময়ে সময়ে বাওড়ের ইজারা বর্ধিত হয়ে আসছে। কিন্তু চলতি বছরের ৬ জুন চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মনিরা পারভীন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বেণীপুর বাওড় হতে খাস আদায় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
জীবননগর উপজেলা জলমহাল খাস আদায় কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বেণীপুর বাওড় ইফাদ প্রকল্পের আওতায় বাংলা ১৪২৬ সাল পর্যন্ত ইজারা প্রদান করা হয়েছিলো। ইফাদ প্রকল্প বর্তমানে চলমান না থাকায় ভূমি মন্ত্রণালয় বেণীপুর জলমহালটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং চলতি বছরের ৯ জুন জীবননগর উপজেলা জলমহাল খাস আদায় কমিটি এক মাসের জন্য বেণীপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অনুকূলে ইজারা দেন। বেনীপুর বাওড়ের সুবিধাভোগী আব্দুর রব জানান, ৩৪৭ বিঘা জলকরের বেণীপুর বাওড়টি ইফাদ প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করে ৫০ বছরের জন্য ইজারা গ্রহণ করা হয়। ১১৫টি সুবিধাভোগী পরিবারের প্রায় ৭০০ সদস্যের রুজি-রুটি হতো এ বাওড়ে মাছ চাষ করে। বেনীপুর বাওড় ছাড়া আমাদের আয়ের আর অন্য কোনো উৎস নেই। ইতোমধ্যে আমরা ব্যাংক এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ২৫ লাখ টাকার মাছের রেণুপোনা বাওড়ে ছাড়া হয়েছে এবং প্রায় অর্ধকোটি টাকার খাবার দিয়েছি। এখন যদি আমরা বাওড়ের মাছ ভোগদখল করতে না পারি তাহলে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আরেক সুবিধাভোগী শাহাজান আলী বলেন, জীবিকা ও অর্থ উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে আমাদের মাছ চাষ। আমরা বাওড়ে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ চাষসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে থাকি। উৎপাদিত মাছ স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। যা এলাকার ও দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
সুবিধাভোগী রেনু বালা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমরা একেবারে গরিব মানুষ। সরকার আমাদের বাওড় দিয়েছিলো মাছ চাষ করার জন্য। মাছ চাষ করেই আমরা সংসার চালায়। ৫০ বছরের ভেতর আমরা ২৫ বছর চাষ করেছি এবং সামনে আরও ২৫ বছর বাওড়ে মাছ চাষের অনুমোদন রয়েছে। ইতোমধ্যে অন্যরা বাওড় এক মাসের জন্য ইজারা নিয়ে বাওড়ের সব মাছ লুট করে নিয়েছে।
সুবিধাভোগী আলেয়া খাতুন বলেন, আমার স্বামী প্রতিবন্ধী। সন্তান নিয়ে আমার খুব দুরাবস্থা। বাওড়ে কোনোরকম মাছ চাষ করে খেতাম। বাওড় না থাকলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। এছাড়া ঋণের টাকা শোধ করারও কোনো উপায় নেই।
সুবিধাভোগী রমজান আলী বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বাওড় দখলে নিচ্ছে এলাকার প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি। সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাথায় কাফনের কাপড় পরে দাবি আদায়ে মানববন্ধন অব্যাহত রাখবো।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, যেহেতু ইফাদ প্রকল্প চলমান নেই, সেহেতু উক্ত প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে গণ্য হবে। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী প্রকল্প চলমান না থাকায় জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ৩ (খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে উক্ত বাওড় ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যাস্ত হয়েছে। এ কারণে অধিক পরিমাণে সরকারি রাজস্ব আদায়ের জন্য বাওড়টি নতুন করে ইজারা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More