স্টাফ রিপোর্টার: কুষ্টিয়া শহরের একটি বহুতল ভবনের পার্কিং থেকে জব্দ বিলাসবহুল গাড়িটি সেখানে নিয়ে আসেন বিএনপির সাবেক এক নেতা। প্রায় তিন মাস আগে পার্কিংয়ে রাখার পর থেকে গাড়িটি আর বাইরে বের করা হয়নি। তবে একটি তামাক কোম্পানিতে কর্মরত ওই সাবেক বিএনপি নেতার গাড়িচালক মাঝেমধ্যে পার্কিংয়ে এসে গাড়িটি চালু করে দেখতেন। সাফিনা টাওয়ার নামে ওই ভবনে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী, গাড়িচালক ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির সাবেক ওই নেতার নাম মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে খোকন। তার বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়া এলাকায়। তিনি বিএনপি সরকারের সময় গাংনী পৌর বিএনপির সভাপতি ছিলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে তিনি দীর্ঘ দুই দশক ধরে কুষ্টিয়ায় থাকেন। গত সোমবার দিবাগত রাত একটার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনের বহুতল ভবন সাফিনা টাওয়ারের পার্কিং জোনের বেসমেন্ট থেকে গাড়িটি জব্দ করা হয়। গাড়ির ভেতরে একটি রশিদ পেয়েছে পুলিশ। তাতে গাড়ির নম্বর, ইঞ্জিন নম্বর, চেসিস নম্বরসহ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনারের নাম হাতে লেখা আছে। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, গাড়িটি জব্দ করে প্রথমে ভবনমালিকের জিম্মায় রাখা হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে গাড়িটি কুষ্টিয়া মডেল থানায় রাখা হয়েছে। গাড়িটি ঝিনাইদহের সাবেক এমপির কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কাগজগুলো বিআরটিএ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। তবে অফিস ছুটি থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আনোয়ারুল আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস (ডরিন) বলেন, গাড়ির নম্বরটি দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন গাড়িটি তার বাবার। ভারতের কলকাতায় তার বাবার নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনার পর এবং গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনার পর থেকে গাড়িটি কোথায়, কীভাবে, কার কাছে আছে, তা দেখার বা খোঁজ নেয়ার সুযোগ হয়নি। গাড়িটি উদ্ধারের জন্য তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাফিনা টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) ফয়সাল মাহমুদসহ কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য অবস্থান করছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা ভবনের নিরাপত্তাকর্মী (গার্ড) আশিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি দীর্ঘ ছয় বছর ধরে এই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্বে রয়েছেন। নিরাপত্তাকর্মী আশিকুর রহমান বলেন, গত বছরের ১ জুলাই মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক ব্যক্তি ভবনের তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তিনি তামাক কোম্পানিতে বড় পদে রয়েছেন। ভবনের নিচে ৬ ও ৭ নম্বর গ্যারেজও ভাড়া চুক্তিতে নেয়া ছিলো। ৬ নম্বর গ্যারেজে মোস্তাফিজুরের কোম্পানির ব্যবহৃত একটি গাড়ি রাখা হতো। ৭ নম্বর পার্কিংয়ের জায়গাটি ফাঁকাই ছিলো। প্রায় তিন মাস আগে প্রাডো গাড়িটি মোস্তাফিজুর রহমান তার চালক দিয়ে ৭ নম্বর পার্কিংয়ে এনে রাখেন উল্লেখ করে আশিকুর রহমান আরও বলেন, এরপর অদ্যাবধি গাড়িটি বাইরে বের করতে দেখেননি। তবে মোস্তাফিজুরের আরেক গাড়ির চালক শান্ত দুই থেকে তিন দিন পরপর প্রাডো গাড়িটি চালু (স্টার্ট) করে কয়েক মিনিট চলার পর ঢেকে রাখতেন। মোস্তাফিজুর রহমান তার পরিবার নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। বাকিগুলো কোম্পানির লোকজন মাঝে মধ্যে ব্যবহার করেন। তবে ২০ দিন আগে মোস্তাফিজুর পরিবার নিয়ে চলে গেছেন। পুলিশ ও স্থানীয় কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, ‘জেনুইন লিফ কোম্পানি নামে একটা সিগারেট কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এই কোম্পানি ৫ আগস্টের আগে তারা টোব্যাকো নামে ছিলো। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কোম্পানির নাম ও মালিকানা পরিবর্তন হলেও কর্মকর্তা একই থাকেন। এই কোম্পানির পুরোনো কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন সবকিছু দেখভালো করেন।
তামাক কোম্পানিটির গাড়িচালক শান্ত বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে আমি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলীর গাড়ির চালক ছিলাম। এখন আর নেই। আমি জেনুইন লিফ কোম্পানির গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করি। জিএম বিল্লাল স্যার ও সিইও জাহিদ স্যারের গাড়ি চালাই। তারা দুজন আমাকে চাবি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলেন। জেনুইন লিফ টোব্যাকোর বিল্লাল ও জাহিদ স্যারের হুকুমে আমি স্টার্ট দিয়েছি। গাড়ির মালিক কে, তা আমি জানি না।’
সাফিনা টাওয়ারে বাড়িভাড়া চুক্তিপত্রে মোস্তাফিজুর রহমানের দেয়া তথ্যের মধ্যে মোবাইলফোন নম্বরও দেয়া হয়েছে। সেই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের পাবলিক রিলেশন অফিসার পরিচয় দেয়া ব্যক্তি নিজের নাম জানান এস এম সালেহ বিন উৎস। তিনি বলেন, এক মাস আগে তিনি এই কোম্পানিতে যোগদান করেছেন। প্রায় ১৫ দিন আগে ভাড়ার চুক্তি বাড়ানোর সময় তার ফোন নম্বর চুক্তিপত্রে দেয়া হয়েছিলো। তিনি এখনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। এর বেশি কিছু জানেন না বলে তিনি জানান। মোস্তাফিজুর রহমানের মোবাইলফোন নম্বর চাইলে তার কাছে নেই বলেও তিনি জানান। পরে দিতে পারবেন। ২০ মিনিট পর ফোন দিতে বলেন। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
মেহেরপুরের গাংনী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি সরকারের আমলে মোস্তাফিজুর রহমান সক্রিয় বিএনপির রাজনীতি করতেন। আওয়ামী লীগের আমলে তিনি কুষ্টিয়ায় চলে আসেন। এখানেই ব্যবসা করেন। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে গাংনীতে কয়েকবার গিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। তবে কয়েক মাস ধরে তাকে আর কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি।
মেহেরপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন বলেন, মোস্তাফিজুর রহমান একসময় গাংনী পৌর বিএনপির সভাপতির পাশাপাশি জেলা বিএনপির সহসভাপতিও ছিলেন। পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। বর্তমানে তামাকের ব্যবসা করেন বলে জানেন। বিলাসবহুল গাড়িটি জব্দের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকায় অনেক জল্পনাকল্পনা চলছে। গাড়িটিতে চড়ে মোস্তাফিজুর রহমানের পরিবারের এক সদস্য কিছুদিন আগে একবার এলাকায় এসেছিলেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.