মুন্নির কারণেই কি তিন্নির আত্মহত্যা?

স্টাফ রিপোর্টার: ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী উলফাত আরা তিন্নির মৃত্যুরহস্য উন্মোচিত না হলেও নেপথ্যে বেরিয়ে এসেছে দুই কাহিনী। মেজো বোন মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলের সাথে কলহ বিবাদে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়েই তিন্নি আত্মঘাতি হয়েছেন বলে স্বজন ও প্রতিবেশীরা ধারণা করছেন। অপরদিকে উঠে এসেছে তিন্নির বোন মুন্নির সাথে রাজু আহমেদ নামের এক ছেলের সম্পর্ক, সম্পর্কের সূত্র ধরে বাড়িতে যাতায়াত এবং বিয়ে সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে পারিবারিক কলহ-অশান্তি। তবে তিন্নির মৃত্যু নিয়ে তার মা ও বোন সুস্পষ্ট কোনো কথা না বললেও এ ঘটনায় দায়ী করেছেন মেজ বোন মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলকে। মেজ মেয়ে মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলের ধর্ষণের শিকার ছোট মেয়ে তিন্নি লজ্জা-অপমানে আত্মহত্যা করে বলে মামলায় উল্লেখ করেন তার মা হালিমা খাতুন। এদিকে, ঘটনার তিনদিন পর গতকাল সোমবার পাওয়া গেছে তিন্নির ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মেলেনি ধর্ষণের আলামত, আর এটি ছিলো সুইসাইডাল হ্যাঙ্গিং। সোমবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরএমও ডা. তাপস কুমার সরকার।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ঝিনাইদহের শেখপাড়া গ্রামের উলফাত আরা তিন্নির মৃত্যুরহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। মৃত্যুর দায় তার মেজ বোনের সাবেক স্বামী জামিরুলের ওপর থাকলেও এর নেপথ্যে বেরিয়ে এসেছে আরও এক কাহিনী। উঠে এসেছে তিন্নির মেজ বোন মুন্নির সাথে রাজু আহমেদ নামের এক ছেলের সম্পর্ক, সম্পর্কের সূত্র ধরে বাড়িতে যাতায়াত এবং বিয়ে সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে পারিবারিক কলহ-অশান্তি। ঘটনার সেই রাতেও তাদের বাড়িতে রাজুর যাতায়াত করা নিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। উচ্চঃস্বরে বাকবিতন্ডার কারণে বাড়ির পাশে লোকজনের ভিড়ও বাড়তে থাকে। ওই সময় নিজেদের সম্মানহানী হচ্ছে এবং তোমরা এসব করলে বাইরে মুখ দেখাবো কি করে বলে দোতলায় নিজের ঘরে চলে যান তিন্নি। এরপরই তিন্নিকে নিজঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।  এছাড়াও স্থানীয়ভাবে মানুষের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে, মুন্নি ও তার ‘বর্তমান স্বামী রাজুকে’ শায়েস্তা করতে তিন্নিকে মানসিক নির্যাতন ও সামাজিকভাবে তাদের পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করার ছক আকে জামিরুল। মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এবং পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার আক্ষেপ থেকে তিন্নি আত্মহত্যা করতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার ওই এলাকা থেকে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। নেপথ্যের নতুন এ কাহিনীর মূলে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে শেখপাড়ার পার্শ্ববর্তী আনন্দনগর গ্রামের রাজু আহমেদ নামের এক ছেলের সাথে মুন্নির সম্পর্ক। ওই ছেলের সাথে সে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতো। জামিরুলকে ডিভোর্স লেটার পাঠানোর পর অনেকটা প্রকাশ্যেই রাজুর সাথে ঘুরতো মুন্নি। তারপরও মুন্নিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলো জামিরুলের পরিবার। পরে লোকমুখে শোনা যায় মুন্নিকে রাজু বিয়ে করেছে এবং রাজু প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাতায়াত করে। কিন্তু মুন্নির মা বরাবরই বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিলেন।

মামলার প্রধান অভিযুক্ত জামিরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, লোকমুখে বিভিন্ন কথা শুনে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গত ১ অক্টোবর রাতে জামিরুল কয়েকজনকে নিয়ে মুন্নিদের বাড়িতে যান। তারা যাওয়ার পর বাড়ির বাইরে থেকে উভয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। সে সময় রাজু বাড়ির দরজা খুলে পালিয়ে যায়। এ নিয়েও তাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। এদিকে, বাড়িতে রাজু আসার খবরটি তিন্নি দিয়েছে জামিরুরলকে, এমনটি ভেবে তিন্নিকে ব্যাপক বকাবকি করে তার মা ও বোন। এছাড়া উচ্চস্বরে বাকবিতন্ডার কারণে আশপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকে বাড়ির সামনে। সে সময় তিন্নি বলে, তোমরা এসব করে সমাজে আমার মানসম্মন নষ্ট করে দিলে। আমি কিভাবে বাইরে বের হবো। মানুষ কি বলবে? এরপর তিন্নি দ্বিতীয় তলায় নিজের ঘরে চলে যান। তারা আরও জানিয়েছে, আর এসব ঘটনার কারণে তিন্নি খুবই অশান্তিতে ছিলো। মুন্নি-জামিরুলের সংসারে ৬ বছরের একটি কন্যাসন্তান থাকায় তাদের মিলিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিলো এবং চেষ্টাও করতো তিন্নি। কিন্তু জামিরুলের পরিবার সাথে তিন্নির যোগাযোগ থাকায় মুন্নি ও তার মা বিভিন্ন সময় তাকে বকাবকি করতো।

গত ১ অক্টোবর রাতে শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে তিন্নির রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। রাত ১২টার দিকে ঘর থেকে অর্ধঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব্বোর্চ ডিগ্রি নিয়ে সদ্য পাস করা তিন্নির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তিন্নির পরিবারের অভিযোগ, গত বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) সকালে তিন্নি কুষ্টিয়ায় এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে তার বোন ইফফাত আরা মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুল ইসলামের হুমকির শিকার হয়। এরপর রাত ১০টার দিকে জামিরুলসহ সংঘবদ্ধ একটি চক্র জানালার গ্লাস ভেঙে ও মই দিয়ে তিন্নির বাড়িতে প্রবেশ করে হামলা চালায়। এরপর রাত ১২টার দিকে ঘরের ভেতরে তিন্নিকে অর্ধঝুলন্ত নিথর অবস্থায় পাওয়া যায়। তিন্নিকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর সেখানে ময়নাতদন্তের জন্য রাখা হয়। ঘটনার পরপরই পালিয়ে যায় মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলসহ অন্যরা। তিন্নিকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে, সৃষ্টি হয় চাঞ্চল্যের। তিন্নির মা হালিমা বেগম, তিন্নির বোন ইফফাত আরা মুন্নি তখনই অভিযোগ করে বলেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনসহ তিন্নিকে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। তিন্নিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে জামিরুল ও সংঘবদ্ধ চক্র। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শৈলকুপা থানায় একটি মামলা করেন তিন্নির মা।

ঘটনার তিনদিন পর সোমবার কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইবির এই শিক্ষার্থীর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সম্পন্ন হয়। চিকিৎসকেরা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট থানায় হস্তান্তর করেছে। হাসপাতালের আরএমও ডা. তাপস কুমার সরকার জানিয়েছেন, তিন্নির ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ধর্ষণের কোনো আলামত মেলেনি, আর এটি ছিলো সুইসাইডাল হ্যাঙ্গিং। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শৈলকুপা থানার ওসি (তদন্ত) মহাসিন হোসেন জানান, তিন্নির মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার রাতে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ আরো অজ্ঞাত ৫-৬ জনের নামে শৈলকুপা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং আত্মহত্যা প্ররোচনায় আইনে মামলা হয়েছে। তিন্নির মা হালিমা বেগম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেছেন। মামলার পর পুলিশ শেখপাড়া গ্রামের কনুর উদ্দিনের ছেলে আমিরুল, নজরুল, লাবিব ও তন্ময়কে গ্রেফতার করেছে। এ মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামি জামিরুল পলাতক রয়েছে। তিনি আরো বলেন, মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে তিন্নিকে হত্যা করা হয়েছে নাকি সে আত্মহত্যা করেছে সেটি জানা যাবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More