যান্ত্রিক ত্রুটি বিহীন কেরুজ চিনিকলে চলতি মরসুমের ৩ মাস আজ : মুখ থুবড়ে পড়েছে আখ রোপণ মরসুম

বয়সের ভারে নুহ্য মিলটি স্মরণকালের রেকর্ড ভাঙলো : হুমকির মুখে ডিস্টিলারি কারখানা

দর্শনা অফিস: ৮৩ বছর বয়সী বুড়ো কেরুজ চিনিকলটি এবারের আখ মাড়াই মরসুমে চমক সৃষ্টি করলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা মিলটি চলতি আখ মাড়াই মরসুমে একবারের জন্যও যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়েনি। অন্যান্য মাড়াই মরসুমের তুলনায় এবারের মরসুমে আখ মাড়াইয়ের গড়হারও তুলনামূলক বেশি। চিনি আহরণের গড়হার বৃদ্ধি না পেলেও চিনির গুণগত মান এবার বেশ ভালো। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিষদের দক্ষতা, শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের ফসল বলেই মন্তব্য সুধীমহলের। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর কেরুজ চিনিকলের ২০২০-২১ আখ মাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ৯ হাজার ৬২৫ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন করবে কেরুজ চিনিকল। কেরুজ চিনিকলের নিজস্ব ১ হাজার ৫৫০ একর জমিতে ২৪ হাজার মেট্রিকটন আখ, কৃষকের ৬ হাজার ৯৮২ একর জমিতে ৯৪ হাজার মেট্রিকটন আখ দন্ডায়মান ছিলো। এছাড়া বন্ধ হওয়া কুষ্টিয়া জগতি চিনিকলের আওতাধীন কৃষকদের ৩৬ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই হওয়ার কথা ছিলো কেরুজ চিনিকলে। শেষ অবধি তা কমে ১৪ হাজার মেট্রিকটনে দাঁড়িয়েছে। বাকি ২২ হাজার মেট্রিকটন আখ গুড় উৎপাদক করেছেন চাষিরা। যে কারণে কেরুজ চিনিকলে এবারের মরসুমে সর্বমোট আখ মাড়াই হতে পারে ১ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিকটন। ফলে মাড়াই দিবস বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০। চিনি আহরণের গড় হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশশিক ২৫ শতাংশ। গতকাল সোমবার চলতি আখ মাড়াই মরসুমের ৮৮ দিবস ছিলো। ৮৮ দিবস পর্যন্ত এ চিনিকলে আখ মাড়াই করেছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৭০ মেট্রিকটন। প্রতিদিন আখ মাড়াইয়ের গড় হার ১ হাজার ২০৮ মেট্রিকটন। চিনি উৎপাদন করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৬০ মেট্রিকটন। চিনি আহরণের গড়হার ছিলো ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। এবারো যেমন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না, তেমনি অর্জন হচ্ছে না চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও। মিলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গিয়াস উদ্দিন জানান, এখনো প্রায় ১১ হাজার মেট্রিকটন আখ রয়েছে। আখ মাড়াইয়ের গড় হার অনুপাতে আগামী আরও ৯ দিন মাড়াই কার্যক্রম চলতে পারে। তবে আগামী ২২ মার্চের মধ্যেই মাড়াই শেষ করার লক্ষ্যে জোরালো ভূমিকা চলছে। কুষ্টিয়া চিনিকলের আওতাধীন ৩৬ হাজার মেট্রিকটন আখের মধ্যে এ পর্যন্ত মাড়াই হয়েছে ১৪ হাজার মেট্রিকটন। কুষ্টিয়া থেকে আখ সরবরাহ আপাতত শেষ। এবারের আখ মাড়াই মরসুমে কেরুজ চিনিকল লাভের মুখ না দেখলেও বিগত বছরের তুলনায় লোকসানের বোঝা কমতে পারে অনেকটা এমনটাই ধারণা শ্রমিক-কর্মচারীদের। ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরুজ চিনিকলটি স্মরণকালের রেকর্ড ভাঙলো এবার। ৮৮ আখ মাড়াই দিবসের মধ্যে ১ মিনিটের জন্যও হয়নি ব্রেকডাউন। কোনো প্রকার যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়তে হয়নি মিলটিকে। চিনিকলের প্রবীন ও দক্ষ বেশ কয়েকজন শ্রমিক-কর্মচারীর কাছ থেকে কারণ হিসেবে জানা গেছে, ব্যবস্থাপনা পরিষদের দক্ষতা, সঠিক দিক নির্দেশনা, দক্ষ লোকবল নিয়োগ, চাহিদা মোতাবেক যন্ত্রপাতিসহ সবধরনের মালামাল সরবরাহ, বিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন, করোনাকালীন সময়েও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিরলস পরিশ্রম, সকল প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম ধরে ন্যায্য ও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করার কারণেই এবার কোনো প্রকার যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়তে হয়নি মিলটিকে। যে কারণে চিনি কারখানা যেমন ত্রুটিহীনভাবে চলছে, তেমনি চিনির গুণগত মানও স্মরণকালের সকল রেকর্ড ভেঙেছে। উন্নত মানের চিনি উৎপাদন হচ্ছে এ মিলে। তবে আখ মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে হুমকির মুখে পড়তে হবে আগামী ২০২১-২২ মরসুম। দেশের ৬টি চিনিকল বন্ধ হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টির কারণে চলতি রোপণ মরসুমও পড়েছে মুখ থুবড়ে। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় আখ রোপণ মরসুম। রোপণ কার্যক্রম শেষ বললেও হবে না ভুল। এবারের আখ রোপণের ক্ষেত্রে চরমভাবে হতাশ মিল কর্তৃপক্ষ। ৯ হাজার ৩৫০ একর জমিতে আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে কেরুজ নিজস্ব জমির পরিমাণ ১ হাজার ৪৪৩ একর ও কৃষকদের ৭ হাজার ৯০৭ একর জমিতে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত টানা ৬ মাস ১৪ দিনে রোপণ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ১৬৩ একর জমিতে। কেরুজ নিজস্ব জমিতে ৯৪০ ও কৃষকের ৩ হাজার ২২৩ একর জমিতে রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া কয়েক একর মুড়ি আখও রয়েছে। যদিও চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে রোপণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে আদৌ আর কোনো জমিতে আখ রোপণ হবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। এ পর্যন্ত যে পরিমাণ জমিতে আখ রোপণ করা হয়েছে তাতে আগামী ২০২১-২২ মরসুমে আখের পরিমাণ হতে পারে ৫০ হাজার মেট্রিকটন। গড় আখ মাড়াইয়ের হিসেব আনুযায়ী ওই বছর চিনিকলে আখ মাড়াই হতে পারে মাত্র ৪১ দিন। আখ রোপণের কারণে শুধু চিনিকলই নয় হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে ডিস্টিলারী কারখানা। কারণ হিসেবে জানা গেছে, কেরুজ ডিস্টিলারি কারখানায় মদ উৎপাদনের একমাত্র কাচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় মুলাসেস। প্রতি বছর ডিস্টিলারির জন্য মুলাসেস প্রয়োজন প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিকটন। এর মধ্যে কেরুজ চিনিকলে প্রতি আখ মাড়াই মরসুমে ৪ হাজার মেট্রিকটন মুলাসেস পাওয়া যায়। বাকি ১৪/১৫ হাজার মেট্রিকটন মুলাসেস সংগ্রহ করা হয় দেশের অন্য ১৪টি চিনিকল থেকে। চলতি মরসুমে ৬টি চিনিকল বন্ধ হওয়া আখচাষিদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে গোটা দেশেই। যে কারণে এবার কেরুজ এলাকায় আখচাষের পরিমাণ একেবারেই নগন্য। ফলে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে কেরুজ ডিস্টিলারি কারখানার উৎপাদন। তবে আখের পরিবর্তে বিকল্প উপায় অবলম্বন করা হবে কিনা তা জানা যায়নি। কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সাঈদ জানান, ইচ্ছাশক্তি ও আন্তরিকতা থাকলে সফলতার স্বর্ণ শিখরে পৌছানো সম্ভব। কেরুজ চিনিকলটি এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। বিভিন্ন কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিলো সরকারের মূল্যবান সম্পদটি। আমি গত বছরের ১২ এপ্রিল কেরুজ চিনিকলে যোগদান করলেও দায়িত্বভার বুঝে পাই ১৬ এপ্রিল। সেসময় দেশে ছিলো করোনার প্রভাব। করোনাকালীন সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি মিলটিকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। দফায় দফায় বৈঠক করেছি কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারীসহ নেতৃবৃন্দের সাথে। সকলের মতামতে ভালো কিছু সিদ্ধান্ত পেয়েছি। অবলম্বন করেছি সঠিক কৌশল। সে মোতাবেক চিনি কারখানা মেরামতের কাজ শুরু করেছি দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের দিয়ে। যখন যেখানে যা যা প্রয়োজন তা সঠিকভাবে মান সম্পন্ন মালামাল সরবরাহ করেছি। তা দক্ষদের মাধ্যমেই স্থাপন করা হয়েছে। সব কাজই করা হয়েছে স্বচ্ছতার সাথে। তাই আজকের এ সুফল মিলের সকল কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের। তবে আমি মনে করি দক্ষতা, দায়িত্বশীলতা, আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে যে যার স্থানে দায়িত্ব পালন করলে তা কখনো বৃথা যায় না। সাফল্যের মুখ দেখবেই। কেরুজ চিনিকলটি এ অঞ্চলকে আলোকিত করে রেখেছে। সেই সাথে করেছে সমৃদ্ধ। তাই সরকারের এ মূল্যবান সম্পদকে বাচিয়ে রাখতে বেশি বেশি করে আখচাষের কোনো বিকল্প নেই।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More