সোহাগ পিতৃস্নেহ পাননি : অনাগত সন্তানেরও একই পরিণতি

চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নিহতদের স্বজনের থামছে না কান্না

রয়েল পরিবহনের চালক আসাদুলের জামিন নামঞ্জুর : জেলহাজতে প্রেরণ

স্টাফ রিপোর্টার: জন্মের এক মাস আগেই পিতৃহারা হয়েছিলেন সোহাগ হোসেন। বাবা তোফাজ্জেল হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ছেলের খোঁজ রাখেননি। পিতৃস্নেহবঞ্চিত সোহাগ প্রায়ই বলতেন, নিজের সন্তানকে প্রাণভরে আদর করবেন তিনি। সব ঠিক থাকলে আর মাসখানেক পর জন্ম নেবে তাঁর সন্তান। কিন্তু তাঁর সন্তানও বাবার মতোই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। বাবার ভালোবাসার ছায়া ছাড়াই বড় হতে হবে সোহাগের সন্তানকে। গত শনিবার চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জে রয়েল এক্সপ্রেস বাসের ধাক্কায় নিহত ৬ জনের মধ্যে একজন সোহাগ হোসেন (২৫)। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সোহাগসহ চারজনেরই বাড়ি তিতুদহ গ্রামে। তারা পেশায় দিনমজুর ছিলেন। সোহাগের কথা বলতে গিয়ে আহাজারি করছিলেন মা আনুরা বেগম। এ সময় মাটির ঘরের মেঝেতে নির্বাক বসে ছিলেন সদ্য স্বামীহারা অন্তঃসত্ত্বা আঁখিতারা খাতুন। বাস চাপায় ৬ জন নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার বাস চালককে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা আমলী আদালতের বিচারক বাস চালককে জেল হাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। চুয়াডাঙ্গা সদর থানা এসআই হাচান বাদী হয়ে দুই জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। রোববার বিকালে পুলিশ প্রহরায় তাকে আদালত থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে নেয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, সোহাগের মতোই নিহত শরিফ হোসেন (৩২), শরিফুল ইসলাম ওরফে জুম্মা কালু (৪০) ও রাজু আহম্মেদের (৩৫) বাড়িতে মাতম। পার্শ্ববর্তী খাড়াগোদা গ্রামের ভেটেরিনারি চিকিৎসক মিলন হোসেনের (৪০) জমিতে ধানের চারা লাগানোর উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুর্ঘটনায় মারা যান তারা। ওই দুর্ঘটনায় মারা যান মিলন হোসেন ও বসু ভান্ডারদহ গ্রামের আলমসাধুচালক ষষ্ঠী হালদার (৪৫)। দুর্ঘটনায় নিহতদের  প্রত্যেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রিয়জন হারানোর পাশাপাশি পরিবারগুলো আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। দুর্ঘটনায় আহত তিতুদহের আলমগীর হোসেন (২৮), মহাম্মদজমার আকাশ (১৮) ও সরোজগঞ্জের বাবলু রহমানের (৪৫) অবস্থা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শামীম কবির।

সোহাগের স্বপ্ন তছনছ: চাষের বা ভিটা জমি না থাকায় গ্রামের কামাল উদ্দিনের জমিতে মাটির ছোট একটি ঘর তুলে মা আনুরা বেগমকে নিয়ে বাস করে আসছিলেন সোহাগ। মায়ের পছন্দেই প্রতিবেশী আঁখিতারা খাতুনকে এক বছর আগে বিয়েও করেন। আঁখিতারা এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মা আনুরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে বারবার বুলতো, আমি কুনু দিন বাপের আদর- সোহাগ পাইনি। আমার সন্তানের খুব আদর করবো, কুনু দিন কষ্ট দেবো না। বাস ডাইবার আমার ছেলের সেই স্বপ্ন শেষ করে দিলো।’

আহাজারি করে আনুরা বেগম বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমার এট্টাই ছেলে। সে জন (শ্রমিকের কাজ করে) বয়ে আমাগের খাওয়ায়। আমার বিটা চলে গেলো। কেউই থাকলো ন্যা। অ্যাকন কিডা খাওয়াবে আমাগেরে? ক্যারাম করে চলব? তুমরা আমার বিটারে আইনে দ্যাও।’

রাজুর রক্তাক্ত দেহ দেখে আতঙ্কিত সন্তান: বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বাবা, বৃদ্ধা মা, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটা বোন এবং স্ত্রী, দুই সন্তানসহ ৭ সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রাজু আহম্মেদ। দিনে দিনমজুর এবং রাতে মুদিদোকানে ব্যবসা করে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন তিনি। একটি দুর্ঘটনায় সব তছনছ হয়ে গেলো পরিবারটির। বাবার রক্তাক্ত মরদেহ দেখে ভয়ে বাড়ি ছেড়েছে ছেলে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আসিফ হোসেন (১০)। সে চলে গেছে নানার বাড়িতে। চার বছর বয়সী মেয়ে লাবণী কেঁদেই চলেছে বাবার জন্য।

শরিফের লুঙ্গি নিয়ে মায়ের আহাজারি: ছেলে শরিফ হোসেনের অকালমৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন মা নবিছন নেছা। শরিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের লুঙ্গি বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন ৭০ বছর বয়সী এ নারী। শরিফের বড় ছেলে রাহুল অষ্টম ও ছোট ছেলে সাব্বির চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র মেয়ে শেফার বয়স এক বছর। দরিদ্র পরিবারটির একমাত্র অবলম্বন স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা স্ত্রী কাজলী খাতুন।

শরিফুল ছিলেন নাসরিনের একমাত্র আশ্রয়: স্বামী শরিফুল ইসলাম ওরফে জুম্ম কালুর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে ইব্রাহিম ও ১১ মাস বয়সী মেয়ে জামিলাকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন স্ত্রী নাসরিন। জীবনের কঠিন সময়েও তাকে সান্ত¡না দেয়ার মতো কেউ নেই। স্বামীর বাড়িতে ভিটে ছাড়া কিছুই নেই। বাবা দ্বিতীয় সংসার করায় সেখানেও যাওয়ার সুযোগ নেই নাসরিনের।

মেয়েকে ঘিরে মিলনের অনেক স্বপ্ন ছিলো: ভেটেরিনারি চিকিৎসক মিলন হোসেনের এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়ে মিলি পারভীন এ বছর এসএসসি পাস করেছে। বড় ছেলে সুলতান সপ্তম ও ছোট ছেলে স্বাধীন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। মৃত্যুর আগের দিনও সহপাঠী বন্ধু জাকির বিশ্বাসের কাছে মিলন হোসেন বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন, মেয়ে চিকিৎসক হবে।’ স্বামী হারিয়ে স্ত্রী পলি খাতুন সন্তানদের নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়ে পড়েছেন।

ছেলেকে ষষ্ঠী ডাকতেন ‘রাজদ্বীপ’ বলে: ষষ্ঠী হালদারের তিন মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেটিকে বাড়ির সবাই শুভ বলে ডাকলেও বাবা আদর করে রাজদ্বীপ বলে ডাকতেন। পাঁচ বছর বয়সী শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, ‘কে আমাকে রাজদ্বীপ বলে ডাকবে?’ ষষ্ঠীর বড় ও মেজ মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। স্ত্রী লিলি রানী স্বামীর কথা বলে আহাজারি করছিলেন।

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তিতুদহের চারজনকেই পাশাপাশি চারটি কবরে সমাহিত করা হয়েছে। স্থানীয় সমাজসেবক শাহীন আলী জানান, এক দিনে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা গ্রামটিতে প্রথম। সরোজগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনায় সদর থানার উপপরিদর্শক মেফাউল হাসান বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এতে গাড়ির চালক আশাদুল আলম, চালকের সহকারী লিটনসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ ফকরুল আলম খান জানান, চালক আশাদুলকে গ্রেফারের পর রোববার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা আমলী আদালতের বিচারক বাস চালককে জেল হাজতে পাঠানো আদেশ দেন। সহকারী লিটন হোসেনের সন্ধানে অভিযান চলছে। চুয়াডাঙ্গা সদর থানা এসআই হাচান বাদী হয়ে দুই জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। রোববার বিকালে পুলিশ প্রহরায় তাকে আদালত থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে নেয়া হয়। গ্রেফতার চালক আসাদুল আলম চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ফার্মপাড়ার আব্দুল ওহাব ছেলে। এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রোববার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা আমলী আদালতে সোপর্দ করা হয়। চুয়াডাঙ্গা আমলী আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রট সাজেদুর রহমান তার জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। বিকালে তাকে পুলিশ প্রহরায় চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে নেয়া হয়। এর আগে শনিবার সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে যাত্রীবাহি বাসের চাপায় ৬ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়। এ ঘটনায় সদর থানার এসআই হাচান বাদী হয়ে দুই জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেন। গাড়ির চালক আসাদুল আলমকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ শহরের বড়বাজার এলাকা থেকে আটক করে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More