বিয়ে বন্ধ করোনায় : বিয়ের সাথে জড়িত পেশাজীবীরা সঙ্কট

আতিয়ার রহমান মুকুল: যার বিয়ে তার খোঁজ নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই। এখনও দেশে এভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়েই অধিকাংশ বিয়ে হয়। কারণ, বিয়ে মূলত সামাজিক স্বীকৃতি, সামাজিক চুক্তি। সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার গঠনের স্বীকৃত পদ্ধতি বিয়ে। প্রাচীন এ প্রথাই এখনও পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। ফলে বিয়েকে কেন্দ্র করে পাড়াপড়শিদের ঘুম হারাম হওয়াটা সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বিয়ের অনুষ্ঠান মানে উতুঙ্গ আনন্দ আয়োজন। অথচ এমন আনন্দঘন উৎসব ম্লান করে দিয়েছে করোনা সঙ্কটকাল। বলতে গেলে বিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে এ করোনা সঙ্কটে।
আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রার মাওলানা ওমর ফারুক জানান, করোনা ভাইরাস দেশে আসার পূর্বে প্রতিমাসে প্রায় ১০-১২টি বিয়ে পড়াতেন। গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ২টি বিয়ে রেজিস্ট্রি করেছিলেন। আজোবধি প্রায় ২ মাস হাত গুটিয়ে বসে আছেন। বিয়ে রেজিস্ট্রির জন্য কেউ তাকে খোঁজ করেন না।
আলমডাঙ্গা উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের ইউনিয়ন নিকাহ রেজিস্ট্রার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ জানান, গত ২ মাসে একটি বিয়েও রেজিস্ট্রি হয়নি। তবে তিনটি বিয়ে রেজিস্ট্রির কাজ হাতে রয়েছে। সেগুলো পারিবারিকভাবে ব্যাপক আয়োজন করে বিয়ে হবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ভালো না হলে তা সম্ভব হচ্ছে না।
ডাউকী ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্টার মাওলানা জহুরুল ইসলাম জানান, গত এপ্রিল মাসে ১টি বিয়ে পড়িয়েছিলেন মাধবপুর গ্রামে। একেবারে পানসে বিয়ে। বরযাত্রী ছিলো না। উভয়পক্ষের ৯জন উপস্থিত ছিলেন। তারপর গত সপ্তাহে হাউসপুরে এক বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এলাকাবাসীর বাঁধার মুখে সে বিয়ে হয়নি। তিনি বলেন, অনেক মেয়ের অভিভাবক এ সময়ে চুপি চুপি বিয়ে দিতে রাজি থাকলেও বরের অভিভাবক সম্মত না। তারা বরযাত্রী নিয়ে হৈ চৈ করে বিয়ে দিতে চান।
উপজেলার বেলগাছি গ্রামের আতিকুর রহমান। তিনি একটি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন। তিনি জানান, আঞ্চলিক রীতি অনুযায়ী আগে বরের আত্মীয়-স্বজন কনের বাড়ি যায় কনে দেখতে। পছন্দ হলে কনেপক্ষ বরের বাড়ি যায় ঘর-বর দুটোই দেখতে। সে সময় উভয়পক্ষের আত্মীয় স্বজন উপস্থিত থাকেন। খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ উল্লাস করেন। তারপর গায়ে হলুদ, ক্ষির খাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীদের ঘুম হারাম অবস্থা হয়। এগুলো একজন পাত্রীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নও। এ আনন্দ অনুষঙ্গ ছাড়া আনুষ্ঠানিক বিয়ে কল্পনার অসাধ্য।
গত ১৪ মে আলমডাঙ্গা কলেজপাড়ায় এক ঘরোয়া বিয়ের আয়োজনে সাক্ষাৎ হয় বেলগাছি ইউনিয়ন নিকাহ রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী খানের সাথে। এসময় তিনি জানান, গত ৩ মাসে মাত্র ৩টি বিয়ে পড়িয়েছেন। বলতে গেলে করোনায় বিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কাজীর দিন কাটছে পরিজন নিয়ে বড় কষ্টে। সাহায্যের জন্য হাতও পাততে পারেন না, আবার সংসারও চলে না। কুল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থা।
উপজেলার ভাংবাড়িয়া ইউনিয়ন কাজী মাওলানা মোহাম্মদ আলী বলেন, বিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। নিকাহ রেজিস্ট্রাররা সরকারি বেতন পায় না। বিয়ে পড়ানোর কাজকে অনেক বছর ধরে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু বিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারাবস্থায় আছেন। লকডাউনে বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করার সুযোগ নেই। অথচ, তাদের নিয়ে ভাববার কেউ নেই।
করোনা সঙ্কটে বিয়ে আটকে আছে আলমডাঙ্গা উপজেলার উসমানপুর গ্রামের আহসান হাবীবের (ছদ্ম নাম)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময়ে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন নিজের সহপাঠী এক মেয়ের সাথে। গত প্রায় ১ বছর হয় আহসান হাবীব একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন। দুই পরিবারকে সম্মত করিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে বিলম্ব হয়ে গেলো। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত পারিবারিকভাবে ঠিক ছিলো। কিন্তু করোনার জন্য এখন সে বিয়ে সম্ভব হচ্ছে না। কেন সম্ভব হচ্ছে না? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আহসান হাবীবের কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই মারুফ হাসান (ছদ্ম নাম) জানান, এ করোনার বিপদে ভাইকে বিয়ে দেবেন না। তার মতে, বড় ভাইয়ের বিয়ে তো স্বপ্নের ঘটনা। চোখ বুজলেই দেখতে পায়, বরকে নিয়ে তারা গেটের সামনে। গেট আটকে দাঁড়িয়েছে সদ্য পার্লার ফেরত একদল পরম সুন্দরী। তাদের কলহাস্য আর রিনিঝিনি শব্দ যেন এখন কানে বাজছে।
একটা সময়ে এ অঞ্চলে পালকি ছিলো। ছিলো পালকিবাহক বেহারাদের বসবাস। গৃহস্থ কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ের সময় পালকি অপহার্য ছিলো। তাছাড়া উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরা সারা বছরই পালকিতে যাতায়াত করতেন। উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণির ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদার সম্প্রদায় পালকি ও ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। পালকি ছিলো আভিজাত্যের প্রতিক। সেকারণে দরিদ্র মানুষও শখ করে পালকিতে চড়ে বিয়ে করতে যেতেন। তাদের শখ ছিলো এমন যে জীবনে বিয়ে উপলক্ষে হলেও অন্তত একদিন পালকিতে চড়া। সমাজে পালকি বাহক এক শ্রেণির পেশাজীবী ছিলেন। তাদেরকে বলা হত বেহারা। বেহারা কাঁধে পালকি টানতেন। পালকি ও বেহারা হয়ে আছে অনেক বিখ্যাত কবিতা ও গানের সজিব উপাদান। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকার পালকি নিয়ে অপূর্ব গায়কী তো বাংলা গানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
“দোলা হে দোলা হে দোলা হে দোলা/আঁকা-বাঁকা পথে মোরা/কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই রাজা মহারাজাদের দোলা, ও দোলা/আমাদের জীবনের ঘামে ভেজা শরীরের/বিনিময়ে পথ চলে দোলা, হে দোলা/হেইয়ানা/হেইয়ানা/হেইয়ানা/হেইয়ানা। দোলার ভিতরে ঝলমল করে যে/সুন্দর পোষাকের সাজ/আর ফিরে ফিরে দেখি তাই/ঝিকমিক করে যে মাথায় রেশমের তাজ/হায় মোর ছেলেটির উলঙ্গ শরীরে/একটুও জামা নেই খোলা/দু’চোখে জল এলে মনটাকে বেঁধে যে/তবুও বয়ে যায় দোলা হে দোলা/ যুগে যুগে ছুটি মোরা কাঁধে নিয়ে দোলাটি/ দেহ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পরে হো পড়ে।/ ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু রাজা মহারাজাদের/ আমাদের ঘাম ঝরে পড়ে হো পড়ে /উঁচু ঐ পাহায়ে ধীরে ধীরে উঠে যাই/ ভালো করে পায় পা মেলা/ হঠাৎ কাঁধের থেকে পিছলিয়ে যদি পড়ে আর দোলা যাবে নাকো তোলা/ রাজা মহারাজার দোলা/ বড় বড় মানুষের দোলা /ও দোলা আঁকা-বাঁকা পথে মোরা/ কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই/ রাজা-মহারাজাদের দোলা/ হে দোলা হে দোলা হে দোলা হে দোলা।।” এখন পালকির স্বর্ণযুগ নেই। নেই পাল্কির দুর্দম বেহারারা। পালকির জায়গা দখল করেছে যান্ত্রিকযান প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস। ফলে বেহারারা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছেন।
পালকির চাহিদা না থাকলেও বেশ যতœ করে গোয়ালঘরের আড়াই পাল্কি তুলে রেখেছেন আমতৈল গ্রামের বেহারা সোহরব সর্দ্দার। তিনি জানান, বিয়ের মরসুমে কোন কোন বড়লোকদের শখ হয় পালকি চড়ে বিয়ে করতে। বছরে ২/১ বার এমন সৌভাগ্য দৈবাৎ ঘটে। কিন্তু করোনায় তো বিয়ে বন্ধ। পালকি ভাড়া তো দুরের কথা।
আলমডাঙ্গা মাইক্রোবাস সমিতির সভাপতি আহমেদ রঞ্জু জানান, পূর্বে প্রতিদিনই প্রায় বিয়ের ভাড়ায় যেতে হতো। শুক্রবারে তো ডবল বিয়ের ভাড়াও হতো। কিন্তু করোনার কারণে প্রায় ২ মাস বেকার। বিয়েসহ সকল ভাড়া বন্ধ। বসে বসে খায়। জমানো টাকা বলতে গেলে কোন ড্রাইভারদেরই নেই। অনেক ড্রাইভার স্ত্রী, সন্তান নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছেন বলে দাবি করেন। বিয়ের ভোজের রান্নাবান্নার সকল ঝাক্কি সামলান বাবুর্চি বা শেফ। করোনাসঙ্কটে কেমন আছেন বাবুর্চি পেশাজীবীরা? আলমডাঙ্গার রাধিকাগঞ্জের নামকরা বাবুর্চি আহমেদ আলী। তিনি জানান, ২ মাস পূর্বে ভালোই ছিলেন। প্রতিদিন বিয়ের রান্নাবান্না না থাকলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ ছিলো। একদিনও বেকার বসে থাকেননি। বিয়ের আয়োজনে খাওয়া দাওয়া ভালো হতো। বাড়িতে বেঁধে খাবার দাবার নিয়েও যেতেন। এখন খুবই দূরাবস্থা। কতদিন বসে বসে চলবে সেই ভাবনায় অস্থির তিনি।
আলমডাঙ্গার এরশাদপুরের বাবুর্চি পিরু মিয়া। তিনি জানান, করোনার কারণে শুধু একজন বাবুর্চিই বেকার হয়নি। একজন বাবুর্চির সাথে ৪/৫ জন সহকারী থাকেন। তারাও বেকার হয়েছেন। বড্ড দুর্দিন তাদের। কত দিন করোনার দাপট থাকবে তা কেউ বলতে পারছেন না। তিনি বসে আর কতদিন খাবেন? তাই শেষ পর্যন্ত ছেলের হোটেলে কাজ করছেন। কিন্তু তার ৪/৫ জন সহকারী খুব কষ্টে আছেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More