মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলেন ব্যারিস্টার বাদল রশিদ

 

রহমান মুকুল: অবশেষে রাষ্ট্রীয়ভাবে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হলো বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ব্যারিস্টার বাদল রশিদকে। বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। গত শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট জাজেস স্পোর্টস কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রয়াত বাদল রশিদের ছেলে প্রভাষক তাপস রশিদের হাতে এ সম্মাননা স্মারক ও সংকলিত স্মারকগ্রন্থ তুলে দেয়া হয়।

প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান, খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এম আমির-উল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মমতাজ উদ্দিন ফকির, অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মো. আমিন উদ্দিন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. শহীদুজ্জামান সরকার, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ প্রমুখ। শেষে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সকল সদস্যকে সম্মাননা স্মারক ও স্মারকগ্রন্থ প্রদান করেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও অন্যতম সংবিধান রচয়িতা ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে এখন স্মরণ করেন না কেউ। সীমাহীন কষ্টের বিষয় যে, তার সৃষ্ট কৃষকলীগও রীতিমত স্রােষ্টাকে বেমালুম ভুলে গিয়েছে। তাকে জন্ম মৃত্যুদিনেও স্মরণ করে না। মূল্যায়িত হন না স্থানীয় নিজ দলীয় নেতাদের কাছেও। বর্তমান প্রজন্মও ভুলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার বাদল রশীদের অসামান্য অবদান। আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত রামদিয়া গ্রামে ১৯২৯ সালের এই দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। পিতা রুস্তম আলী বিশ্বাস ছিলেন তৎকালীন কলকাতা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বাদল রশীদ ১৯৫২ সালে লন্ডন গমণ করেন বার-এ্যাট-ল পড়তে। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডনের লিংকস ইন কলেজ থেকে বার-এ্যাট-ল পাস করেন। এ সময় থেকেই তিনি তার সহজাত নেতৃত্বদানের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। লন্ডনে তিনি কলেজে পড়ুয়া বিভিন্ন দেশের সতীর্থদের নিয়ে গঠণ করেন ‘ব্যাক টু দ্যা ভিলেজ’ নামের সংগঠণ। সা¤্রাজ্যবাদের স্বর্গভূমি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে তরুণ বয়সেই তিনি যে আদর্শের মন্ত্রবীজ অস্তিত্বে ধারণ করেছিলেন, শেষ বয়সে গ্রামে বসবাসের মধ্যদিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬১-৬২ সালের ঘটনা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিন্ড মার্শাল আয়ুব খান লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাস ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক। নির্ধারিত সময়ে ঘটল এক অঘটন। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির চেয়ারে এক বাঙ্গালী ছাত্র হঠাৎ এসে বসে পড়েন। এতে প্রচন্ড অপমানিত হন আয়ুব খান। অথচ নাটকীয়ভাবে এঘটনার মধ্যদিয়ে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্র উন্মোচিত হয় ব্যারিস্টার বাদল রশীদের সামনে। তিনি সহজেই ‘হিরো ইমেজ’ গড়ে তুলতে সমর্থ হন। অল্প সময়েই দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর। বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের কানেও এ তথ্য পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। তিনি তরুণ বাঙালী সমাজের সেনসেশন ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে ডেকে নেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। এরপর ১৯৬৩ সালে ব্যারিস্টারি পাস করার পরে দেশে ফিরলে তিনি ওই ঘটনায় আটক হন। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠান। ১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর আসে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা ‘৭১ সাল। সে সময়ে প্রবাসী সরকারের তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল লিয়াজো অফিসার ও প্রবাসী সরকার প্রধান তাজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী। তার অফিস ছিলো কলিকাতা ৫১ নম্বর প্রিন্সেস স্ট্রীট।

মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তার ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠণ করতে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি অল ইন্ডিয়া ডক ইয়ার্ড শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি কুলকি নায়ারের মাধ্যমে আমেরিকার ডক ইয়ার্ড শ্রমিকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কীভাবে আমেরিকা থেকে যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান মানবতা বিরোধী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ডক ইয়ার্ড শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে তৎকালীন আমেরিকান সরকার নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েন। সেকারণে আমেরিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধের সহযোগিতা করতে পাকিস্তানে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে পারেনি। সপ্তম নৌবহর এসে পৌঁছুলে মুক্তিযুদ্ধের কত বেশি ক্ষতি হতো তা সহজেই অনুমেয়। তিনি লন্ডন শহরে অবস্থিত তার একমাত্র বাড়িটিও জনমত গঠণের কাজে ব্যবহার করতেন। তার লন্ডনের ‘বাংলাদেশ হাউজ’ নামের বাড়িটি প্রবাসী সরকারকে দান করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ওই বাংলাদেশ হাউজটি বাংলাদেশ দূতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে বাড়িটি ‘পুরাতন হয়ে গেছে’ এই অজুহাতে বিক্রি করে দেয়া হয়। মরহুম সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বাড়িটি বিক্রি করা হয়।

সাংস্কৃতিক দূত: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠণ ছাড়াও তিনি প্রবাসী সরকারের আর্থিক তহবিল গঠনে নামেন। তিনি ‘বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে মুম্বাইসহ ভারতের সকল বড় বড় শহরে অনুষ্ঠান করেন। তৎকালীন শান্তিনিকেতনের উপাচার্যের সহযোগিতায় আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, সরদার আলাউদ্দিন, নমিতা ঘোষ, মকছেদ আলী শাহসহ ভারতের নামিদামী বাঙ্গালী শিল্পীদের নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার বাদল রশীদের অনস্বীকার্য অবদান। অবদানের কথা প্রায় সকলের অজানা অধ্যায়। প্রবাসী সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট যখন বার বার ধর্ণা দিয়েও বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিতে পারছিলেন না। তখন ব্যারিস্টার বাদল রশীদ দিল্লীর জামে মসজিদের প্রধান ঈমাম সাহেবকে বুঝিয়ে তাকে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিকট সুপারিশ করান। তার সুপারিশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন ইন্দিরা গান্ধী।

কৃষকলীগ প্রতিষ্ঠা: কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু বাদল রশীদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৭২ সালে আজকের দিনে বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু প্রতিষ্ঠাই করেননি, কৃষকলীগকে সাংগঠনিকভাবে প্রতিষ্ঠার কাজও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্পন্ন করেছিলেন। কৃষকদের জন্য তিনিই দেশে প্রথম স্বতন্ত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেন। আজীবন কৃষকদের স্বজন হয়ে তাদের সাথেই তার ছিলো যাপিত জীবন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালের ২৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
1 টি মন্তব্য
  1. Monayem Chowdhury বলেছেন

    ব্যারিস্টার রশীদ সাহেব আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি যখন আলমডাঙ্গা ইস্কুলে পড়তাম । বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনার অশেষ অবদান আছে । তবে এখানে লেখা হয়েছে ” তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ডক ইয়ার্ড শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন ” । দুঃখের বিষয় ইহা একেবারেই সঠিক নয় । রিচার্ড টেইলর লিখিত দি ব্লকেড বইটি যার অবরোধ নামে বাংলাতে অনুবাদ হয়েছে সেখানে প্রকীত ঘটনা জানা যাবে ।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More