আলমডাঙ্গায় মৃতপ্রায় নদীর জনপদে আশা জাগানিয়া সাঁতার প্রতিযোগিতা

রহমান মুকুল: ফারাক্কার প্রভাবে মৃতপ্রায় নদী ও শুকনো খাল-বিলের জনপদ চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা। এক সময়ের প্রবহমান নদীগুলোর এখন শুধুই স্মৃতি। মাথাভাঙ্গা, নবগঙ্গা, কুমার ও ভৈরবের মতো নদী সময়ের স্রোতে ‘কোন মতে আছে প্রাণ ধরিয়া’। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে স্রোতস্বিনী ভাটুই ও পাঙ্গাসী নদী। খালবিল যা টিকে আছে, সেগুলোও প্রাণহীন; বর্ষা ব্যতীত অন্য সময় হয়তো চেনাই যায় না নদীগুলির ম্রিমান অস্তিত্ব। ফারাক্কার অভিশাপে সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও এমন নিস্তরঙ্গ পানিপ্রবাহের সময়েও আলমডাঙ্গায় গতি আনতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এক ব্যতিক্রমী আয়োজন সাঁতার প্রতিযোগিতা। আগামী ৫ মে আলমডাঙ্গার বুক চিরে বয়ে যাওয়া গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) ক্যানেলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা ঘিরে আয়োজন ও উৎসাহের ঘাটতি নেই। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে অফলাইন-অনলাইন রেজিস্ট্রেশন চলছে। ইতোমধ্যে জিকে ক্যানেল পরিষ্কার করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে রেসকিউ টিম। প্রতিযোগিদের শারীরিক অবস্থা বিচার করে সক্ষমতা জানাবেন মেডিকেল টিম। রেজিস্ট্রেশন ফি ২০০ টাকার বিপরীতে দেয়া হবে একটি টি-শার্ট, ক্যাপ ও নাস্তা। প্রত্যেক প্রতিযোগীর জন্য থাকছে মেডেল। প্রথম ১০জন পাবেন আকর্ষণীয় পরিমাণ অর্থ ও মেডেল। সব মিলিয়ে এ যেন এক উৎসব। এ সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে সবচে বড় সংগঠন ‘আলমডাঙ্গা নাগরিক উন্নয়ন কমিটি।’ আলমডাঙ্গার শহরের টগবগে যুবক সাজ্জাদ জানান, ‘আমাদের শহরের আশপাশে যখন পানি নেই, নদী নেই, তখন সাঁতারের মতো আয়োজন শুধু খেলা নয় একটি বার্তা, যে আমরা হার মানিনি। আমরা নদীকে ভালোবাসি। এই নদীমাতৃক দেশকে ভালোবাসি। আমরা এ মানবীয় সভ্যতা দানবীয় চক্রান্তে শেষ হতে দেবো না।’ শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র বাংলাদেশের সভাপতি আতিকুর ফরায়েজী জানান, পৃথিবীর সকল সভ্যতাই নদী কেন্দ্রিক। নদীকে হত্যা করা তো নিজেকেই হত্যা করা। এই নদী আমাদের প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে বেচে থাকার প্রেরণা যোগায়। তার পলিতে ফসলিল কৃষকের আবাহন। নদী আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির উৎস। এই মৃতপ্রায় নদীগুলি আমাদের বিরূপ পরিস্থিতেও মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র শেখায়। আমাদের মা-মাটির সজীব প্রাণসুধা।’ আলমডাঙ্গা নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘সাঁতার শুধু আমাদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিই করে না। এটা নতুন প্রজন্মকে নদীর প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববান হতে শেখাবে। এই সাঁতার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের জানান দেয়া যে, নদী আমাদের নদীমাতৃক দেশের প্রাণপ্রবাহ। আমাদের অস্তিত্বের নিয়ামক। নদী না বাঁচাতে পারলে আমাদের নদীমাতৃক সভ্যতা হুমকির সম্মুখীন হবে। আমাদের জীববৈচিত্র ধ্বংস হবে। আমাদের স্বার্থেই নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ স্থানীয়দের অনেকেই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি শুধু ক্রীড়াচর্চাই নয়, বরং পানিসম্পদের গুরুত্ব, নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবেশ-সচেতনতা তৈরির এক বাস্তব উদ্যোগ। নদী-বিল-খাল হারানোর এ জনপদে, যেখানে শৈশবের জলস্মৃতি কেবল গল্প হয়ে আছে, সেখানে জিকে ক্যানেলের বুকে কয়েক ঘণ্টার এই সাঁতার প্রতিযোগিতা যেন হারানো প্রবাহের প্রতীক হয়ে ওঠার অপেক্ষা।
শেষ কথা:-নিসর্গের হাহাকার আর জলের শূন্যতায় ক্লান্ত এক জনপদে এ সাঁতার প্রতিযোগিতা যেন বুকে সাহস জুগিয়ে জাগিয়ে উঠেছে পুরোনো স্বপ্নের ধারা। সাঁতার প্রতিযোগিতা নয়, এ যেন জলহীন হৃদয়ে জলের আহ্বান। মরুর বুকে ফোটা এক বিন্দু নীলচে আশা। নদীর শোকগাথায় প্রতিধ্বনিত হবে জীবনের জয়গান। আলমডাঙ্গার এই প্রয়াস কেবল একটি ক্রীড়াযজ্ঞ নয় এ এক প্রতিজ্ঞা, নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণা, আর প্রকৃতির কাছে নিঃশব্দ অনুরোধ “ফিরে এসো নদী, ফিরিয়ে দাও প্রবাহ।’ এই এক আয়োজনেই জেগে উঠতে পারে নদী, নবজন্ম নিতে পারে জনপদ। উদ্ভিন্ন যৌবনা নদীর উর্বরায় জেগে উঠবে আবার ফসলিল আবাহন!

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More