স্বপ্নের তারকা হয়ে ওঠা সেই মামুন জোয়ার্দ্দারের গল্প

স্বপ্নঘেরা জীবনে স্বপ্ন ছোঁয়া ছিলো যে ফুটবলারের স্বভাব
ইসলাম রকিব: স্বপ্নঘেরা জীবনে স্বপ্ন ছোঁয়া ছিলো যে ফুটবলারের স্বভাব। স্বপ্ন থেকে স্বপ্নের তারকা হয়ে ওঠা চুয়াডাঙ্গার সেই কৃতিসন্তান মামুন জোয়ার্দ্দারের গল্প নিয়েই লকডাউনে থেকে আজকের লেখা। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক দ্রুতগতির মাঠ কাঁপানো রাইট উইঙ্গার মামুন জোয়ার্দ্দার। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বয়স ভিত্তিক একটি বাছাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঘরোয়া ফুটবলে আবির্ভাব হয়েছিলো ঝাকড়া চুুুুলের মামুন জোয়ার্দ্দারের। মামুন ঢাকায় এলেই চলে যেতেন স্টেডিয়ামপাড়ায়। মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্সের মতো বড় ক্লাবগুলোর গেটের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে স্বপ্নের তারকাদের খুব কাছ থেকে দেখে প্রীত হতেন। মনে মনে স্বপ্নের জাল বুনতেন একদিন তারকা ফুটবলার হবেন। সেটা তিনি হয়েছিলেনও। মামুনের ঢাকা মাঠে খেলার সূচনাটা হয়েছিলো ১৯৮৫ সালে আজাদ স্পোটিং দলের হয়ে, এরপর চলন্তিকা, ওয়ারী, ভিক্টোরিয়ায় খেলার পর নিজেকে পরিচিত করে তোলেন এবং নজর কেড়ে নেন বড় দলের। এ সুযোগে মোহামেডানই দলে ভিড়িয়ে নেন মামুনকে ৯০-৯১ মরসুমে। মোহামেডানে খেলার পর মামুনকে কেড়ে নেয় আরেক বড় দল আবাহনী। ৯২ হতে ৯৪ আবাহনীতে খেলার পর যোগ দেন মুক্তিযোদ্বা সংসদে। দুই বছর এই দলে খেলার পর ১৯৯৭ সালে ফের আবাহনীর জার্সি গায়ে জড়ান। আর তার লীগ জীবনের ইতি ঘটে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে।
তুখোড় ফুটবলার মামুন জোয়ার্দ্দারের বাংলাদেশ দলে খেলার লালিত স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৮৯ সালে যুব দলের হয়ে। ১৯৯৭ সাল অবধি টানা ৮ বছর ছিলেন জাতীয় দলের এক নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় হয়ে, খেলে গেছেন নৈপূন্যের স্বাক্ষর রেখেই। জাতীয় দলে খেলে তার সংগৃহিত আন্তর্জাতিক গোল সংখ্যা ৯টি। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়ে মামুন খেলেছেন সৌদি আরব, কাতার, চীন, বাহরাইন, দুবাই, কোরিয়া, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা এ ১৩টি দেশে।
মূলত মামুন লাইম লাইটে আসেন ১৯৯২ সালে। মোহামেডান ও আবাহনীর মতো বড় দলে তার শুরুটা শুভ ছিলোনা বলা যায়। কোচ নাসির হেজাজির অপছন্দের তালিকায় থাকার কারণে নিয়মিত খেলা হতো না তার। ক্যারিয়ার বাঁচাতে ৯২ তে আবাহনীতে যোগ দেন। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ফুটবল লীগের মোহামেডান বনাম আবাহনীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আবাহনী ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন আর মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে জয়ের বিকল্প নেই। মোহামেডান ১-০ গোলে এগিয়ে। কোনো এক হাওয়ায় ভাসানো খবর আবাহনীর দর্শক গ্যালরীতে ছড়িয়ে পড়ে এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে মূল একাদশে জায়গা দেয়া হয়নি। সে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে আবাহনীর রিজার্ভ বেঞ্চে। আবাহনীর কোচ কাজী সালাহউদ্দিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন তাকে মাঠে নামাবেন কি-না। এদিকে দর্শক গ্যালারী থেকে চাপ অব্যাহত থাকে তাকে মাঠে নামানোর জন্য। অবশেষে দর্শকদের চাওয়ার প্রতি সম্মান দেখিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামানো হয় সেই স্বপ্নছোঁয়া ফুটবলার স্বর্ণকেশী ঝাঁকড়া চুলের মামুন জোয়ার্দ্দরকে। মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে মোহামেডানের জালে দুইবার বল জড়িয়ে উপস্থিত সব দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন তিনি। সে সময় আবহানীর গ্যালারীতে শুধু বাধভাঙ্গা আনন্দের মামুন বন্দনা। মামুন….মামুন….মামুন। পুরো মোহামেডান গ্যালারীকে স্তব্ধ করে আবাহনীর গ্যালারীতে উঠে ম্যাক্সিকান ঢেউ। যে ঢেউ শেষ পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে আবাহনী ক্লাবে এসে আছড়ে পড়ে।
সেইদিন মামুন জোয়ার্দ্দার উপহার দিয়েছিলেন জীবনের সেরা খেলা। যা ছিলো কিনা মামুনের ফুটবল ক্যারিয়ারের উপরে উঠার টার্নিং পয়েন্ট। আবাহনী সেদিন ২-১ গোলে মোহামেডানকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের দখলে নেয়। অসাধারণ দুটো মূল্যবান গোলই করেছিলেন মামুন। ছিলেন তাই ম্যাচ সেরাও। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মামুনকে। সেই অবিস্মরণীয় সিঁড়ি বেয়ে হয়ে উঠেন আবাহনী আর বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়। মামুন জাতীয় দলের হয়ে স্মরণীয় খেলাটিও খেলেন চ্যাম্পিয়ন ট্রফি এনে দেয়ার মধ্যদিয়ে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ নিয়েছিলো ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি টুর্নামেন্টে। বাংলাদেশ ২-১ গোলে মিয়ানমারকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। জয় সূচক দুটো গোল করেন মামুন ও নকিব। মামুন জোয়ার্দ্দারের সেরা দিক ছিলো তার তাৎক্ষণিক ক্ষিপ্রতা দু-পায়ের সমান কারুকাজ। কথিত আছে, বাংলাদেশে দ্রুতগামির খেলোয়াড়েরা বেশি দিন টিকতে পারে না। কিন্তু মামুন তা ভুল প্রমাণ করেছিলেন। হ্যাঁ, মুন নামক এক খেলোয়াড়ের মাঝেও গতি ছিল, তিনি হারিয়েও গিয়েছিলেন কিন্তু এ মামুন ছিলেন অদম্য।
ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে ভারতের কোলকাতার লিগে তিনি রাইট ব্যাক হয়ে খেলেও বুঝিয়েছলেন, এই মামুন অতি মানবীয় ফুটবল সত্তার একজন। যখন যেমন প্রয়োজন তেমনিটিই দিতে পারেন দলের জন্য। মামুন সম্পর্কে বলতে গেলে তার শ্রমকে সবার আগে মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী খ্যাত মফস্বল শহর চুয়াডাঙ্গার টাউন ক্লাব ফুটবল মাঠে সবাই অনুশীলন শেষ করে বাড়িতে ফিরে গেলেও ফিরতেন না এই মামুন। সবাই বলতো পাগল ! কিন্তু ওই পাগল বালকটি একদিন ঠিকই বুঝিয়ে দেন, আমি হারতে শিখিনি প্রতিপক্ষকে হারাতে শিখেছি। মামুন নিজেও একজন ইউরোপ ঘরানায় খেলতে যাওয়ার মতো খেলোয়াড় ছিলেন। না, জন্মটা যে বাংলাদেশে! তাই হয়নি সেই স্বপ্ন পূরণ। অধরায় থেকে গেছে ইউরোপ আমেরিকার স্বপ্নময় ফুটবল মাঠের সবুজ ঘাসের বুকে ফুটবলীয় কৌশলগুলো প্রদর্শণ করার সুযোগ! তাইতো ২০০০ সালে ঢাকার মাঠ থেকে তার অশ্রুসিক্ত বিদায় কাঁদিয়েছিলো হাজারো ফুটবল প্রেমী ভক্তদের। টানা সাত বছর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে পড়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা মামুন সেদিন বিদায় দিয়েছিলেন ফুটবলকে। তবে তিনি স্বপ্ন ঘেরা জীবনের স্বপ্নের পাখায় ভর করে নিজেকে তুলেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। স্বপ্ন থেকে স্বপ্নের তারকা হয়ে ওঠেন আপন ছন্দে। সে ছন্দের শব্দ মাঝে মাঝে ইথারে ভেসে আসে স্বপ্নের দেশ কানাডা থেকে। তিনি যখন কানাডা থেকে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে দেশে ফিরে নিজের জন্মস্থান চুয়াডাঙ্গায় ফেরেন তখন সাধ্যমত চেষ্টা করেন এ প্রজন্মের ফুটবল খেলায়াড়দেরকে মাঠমুখী করতে। কারণ স্বপ্নঘেরা ওই ফুটবল পাগল মানুষটি যে স্ব-পরিবার বসবাস করছেন কানাডার টোরেনটোতে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More