আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামে লাগাম : প্রভাব নেই দেশের বাজারে

বিশ্বে বাড়লে মুহূর্তেই স্থানীয়ভাবে বেড়ে যায় দাম : কমলে খবর রাখে না কেউ

স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই তা দেশে তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ানো হয়। যদিও বাড়তি দরের পণ্য আমদানি করে বাজারে আসতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়। কিন্তু দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করেন না। দাম বাড়ার আগে কম দামে কেনা পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেয়। এ যেন ব্যবস্থাপনায় অলিখিত ‘স্থায়ী সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। যা চলছে বছরের পর বছর। অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সরকারের তদারকি বাড়লে বাজার থেকে কৃত্রিমভাবে পণ্য উধাও করে দেওয়ারও নজির রয়েছে। ফলে ভোক্তা বাড়তি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। এভাবে ক্রেতাকে জিম্মি করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী প্রায় প্রতিবছরই লুটে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমলে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে এর প্রভাব নেই। বাড়তি দামেই বিক্রি হয়। কম দামে কেনা পণ্য বাজারে আসার পরই দাম কমে ধীরে ধীরে। এই মুহূর্তেও পণ্যের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা আগের কৌশলই অনুসরণ করে চলেছে। বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে সেই অনুপাতে কমছে না। এ ব্যাপারে যেন কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। একরকম নির্বিকার কর্তৃপক্ষ-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

সম্প্রতি প্রতি লিটারে সয়াবিন তেলের দাম ১৪ টাকা কমানোর ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু খুচরা বাজারে কমেছে প্রায় এক সপ্তাহ পর। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম যেভাবে কমেছে তাতে প্রতি লিটারের দাম বাজারে ২০ টাকা কমার কথা। কিন্তু কমেনি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর দাম স্থানীয় বাজারে বেড়ে ছিল। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে ভোজ্যতেল এনে সেগুলো রিফাইন করে বাজারে ছাড়তে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগার লাগার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেই সময়টুকু অপেক্ষা না করেই তাৎক্ষণিকভাবেই দাম বাড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি, ডাল, দুধসহ আরও বেশ কিছু পণ্যের দাম কমেছে। খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চুক্তির পর একদিন গমের দাম কমলেও পরের দিন রাশিয়া ওডেসা বন্দরে হামলা চালালে এর দাম আবার বেড়ে যায়। তারপরও আন্তর্জাতিক গমের বাজার এখন কমতির দিকে। গত ২ থেকে ৩ দিনের গমের দাম ৩ শতাংশ দাম কমেছে। গত এক মাসের হিসাবে কমেছে ১৪ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে আটার দাম ওই ভাবে কমেনি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজার অজুহাতে দেশেও সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছিল।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে-মে থেকে জুন মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম কমেছে ২১৬ ডলার। এ সময় প্রতি টন সয়াবিন তেল দাম ২১১ ডলার, চালের দাম ২০ ডলার, গমের দাম ৬৩ ডলার কমেছে। মে মাসে বিশ্ববাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হয়েছিল ৪৩ সেন্ট। যা জুনে বিক্রি হয়েছে ৪২ সেন্ট।

এদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার ফলে দেশের বাজারেও সমন্বয় করা হয়েছে। তবে যে হারে কমেছে সে হারে সমন্বয় করা হয়নি। প্রতিলিটার সয়াবিন তেল সরকার থেকে ১৮৫ টাকা করে বিক্রির নির্দেশ দিলেও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন এখন লিটারপ্রতি ১৯৫ টাকা।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছিল টনপ্রতি ১৯৫০ ডলার। গত বৃহস্পতিবার এ দর নেমে আসে টনপ্রতি ১৩১৮ ডলারে। অর্থাৎ দেশের ডলার রেট বিবেচনায় লিটারপ্রতি দাম ১২৪ টাকা। দুই মাসে দরপতন হয়েছে ৬৩২ ডলার বা ৩২ শতাংশ। যা ভোজ্যতেলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন। তারপরও দেশে বাজারে সে অনুপাতে তেলের দাম কমানো হয়নি। বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে ২-৩ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮২-৮৫ টাকা। যা আগে ৮০-৮২ টাকা ছিল।

পাশাপাশি বিশ্ববাজারে আটার দাম কমলেও সে অনুপাতে দেশের বাজারে কমানো হয়নি। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ২ টাকা কমিয়ে প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকা। একই অবস্থা ময়দার বাজারে। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২ টাকা কমিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমেছে। আগে যেখানে প্রতি ব্যারেল ১১৫ ডলার ছিল। এখন তা ৯৭ ডলারে নেমে এসেছে। এতে পণ্য পরিবহণ ব্যয়সহ জাহাজ ভাড়া কমেছে। সার্বিকভাবে আমদানিনির্ভর পণ্যের দামও কমার কথা। কিন্তু এখনো কমেনি।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ছয় মাস আগে ৮৬ টাকা দিয়ে ডলার কিনে এলসি খুলতে হয়েছে। এখন খুলতে হচ্ছে ১০২ টাকা দিয়ে কিনে (আমদানির আগাম ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০২ টাকা দরে)। ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে তারা ডলার পাচ্ছেন না। এছাড়া অনেক পণ্যে এলসির পুরো টাকা নগদ জমা দিতে হচ্ছে। আগে কিছু টাকা দিয়ে এলসি খোলা হতো। বাকিটা ঋণ হিসাবে দিত ব্যাংক। আমদানি করা পণ্য বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করা হতো। এখন সে সুযোগ নেই। ফলে আমদানির খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের ভোক্তা অধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে পণ্যের উৎপাদন কমে গেছে। এখন যুদ্ধ থামলেও পণ্যের জোগান স্বাভাবিক আসবে না। কেননা এজন্য নতুন উৎপাদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ অবস্থায় অন্যান্য দেশও পণ্যে সহজে মজুত থেকে ছাড়বে না। কেননা বিশ্ব পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। গত জুনে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে ওঠে। যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুনে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে। মে মাসে ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিই সাধারণ মানুষের বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। রাজধানীর নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, বিশ্ববাজারে দাম কমলে কী হবে, কোম্পানি বলছে এই কম দামে পণ্য আমদানি হয়ে দেশে এলে কম দামে বিক্রি করবে। যে কারণে আমরা বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দরেই বিক্রি করতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে দাম বাড়ালে এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম বাড়লে তো সব জায়গায় বাড়ে। এতে আমরা কী করব।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বে বাড়লে মুহূর্তেই স্থানীয়ভাবে বেড়ে যায় দাম, কমলে এর খবর রাখে না কেউ, বিক্রি হয় বাড়তি দামেই। বিক্রেতারা সব সময় সুযোগ খোঁজে। যে কোনো অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে লাভ করতে চায়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই এই সুযোগ হাতছাড়া করে না। সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে ফেলে। কিন্তু দেখা যায় যে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে তা আগে কম দামে আমদানি করা। কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে সেই পণ্য আমদানি হয়ে দেশে আসতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। আর এই তিন মাসে কম দামের পণ্য বেশি দামে বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে নেয়। তবে দাম কমলে তারা সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয় করে না। এই পরিস্থিতি থেকে ক্রেতাকে স্বস্তি দিতে হবে। দেশে একাধিক বাজার তদারকি সংস্থা আছে তাদের এই বিষয়ে কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলে কেউ এমন অপরাধ করতে সাহস পাবে না।

এদিকে গত শুক্রবার রাশিয়া-ইউক্রেন কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহণে রাজি হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহ বাড়া এবং দাম কমার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু একদিন না যেতেই রাশিয়া ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ও সচল বন্দর ওডেসায় হামলা করেছে। এতে পণ্যের আবার অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে মে মাসে বিভিন্ন শস্যের প্রতি টনের গড় দাম ছিল ১৬৯ ডলার। যা জুনে ১৫৭ ডলারে নেমেছে। এছাড়া খাদ্য প্রতি টনের দাম ছিল ১৪১ ডলার যা জুনে ১৪০ ডলারে নেমেছে।

রাজধানীর নয়াবাজারে পণ্য কিনতে আসা মো. জাকির বলেন, বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেশে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বিশেষ করে ভোজ্যতেল নিয়ে কয়েকদিন আগেই কি একটা অবস্থা গেল। বিক্রেতারা বেশি দামে বিক্রির জন্য দোকান থেকে তেল উধাও করে ফেলে সংকট তৈরি করল। ক্রেতাকে জিম্মি করে বেশি দামে বিক্রি করল। পাশাপাশি প্রতিবছর পেঁয়াজ নিয়েও একই অবস্থার তৈরি হয়। কিন্তু দেখা যায় বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে দাম কমানো হয় না। উল্টো নানা ধরনের অজুহাত দেখিয়ে বেশি দরেই বিক্রি করে। দেখার যেন কেউ নেই।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, তদারকিকালে আমরাও দেখেছি বিক্রেতারা অসাধু পন্থা অবলম্বন করে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে দেশে বাড়িয়ে বিক্রি শুরু করে। তখন আমরা পণ্যের কেনা দাম যাচাই করি। সেখানে অসংগতি দেখলেই আইনের আওতায় আনি। জরিমানার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেছি। তবে এবার আমরা অসাধুদের জেলে পাঠাব। কারণ আমাদের জনবল সংকটের কারণে অসাধুরা সব সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সব সময় আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভোক্তার স্বার্থে কাজ করছি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More