আমলে সংলাপের ১০ প্রস্তাব : ইভিএমের সিদ্ধান্তে হয়নি 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার : চব্বিশ ঘণ্টায় ইসির ভিন্ন অবস্থান

স্টাফ রিপোর্টার: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন, কমিশন ইভিএম’র সার্বিক বিষয়ে এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম’র ব্যবহার বিষয়ে কমিশন যথাসময়ে অবহিত করবে। গত ১৭ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির সংলাপের সুপারিশের ওপর ‘কমিশনের পর্যালোচনা ও মতামত’ জানাতে গিয়ে গতকাল এ সিদ্ধান্ত জানান সিইসি। যদিও রোববার নিজ কার্যালয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওই বক্তব্যের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বিষয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ্যে এলো।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, এর আগেও ইভিএম নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গত ২১ মে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছিলেন, ‘ইভিএমের কোনো ভুল-ত্রুটি যদি কেউ ধরতে পারে তার জন্য আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা প্রদান করেছেন।’ ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ২৫ মে সিইসি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান কিছুটা স্মৃতিভ্রমের কারণে এই বক্তব্য দিয়েছেন।’ এবার ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বক্তব্য দেয়ার পরদিন সিইসি ভিন্ন তথ্য জানিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করলেন। ইসি সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশের ওপর ইসির মতামত সংক্রান্ত ফাইলে রোববার স্বাক্ষর করেন কমিশনাররা। ওইদিনই মো. আলমগীর এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ১০টি সুপারিশের ওপর ইসির পর্যালোচনা ও মতামতে নির্বাচনকালীন সরকার, লেভেল প্লেয়িংফিল্ড নিশ্চিত করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি ইসি। এসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্য না হলে এসব বিষয়ে ইসি কী করবে তাও জানায়নি। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। তবে নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের পাশাপাশি নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ ও ভোটকেন্দ্রে যতদূর সম্ভব সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা জানিয়েছে।

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব যৌক্তিক বলেও মতামত উল্লেখ করেছে। এতে নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরোধীদের বাধা দেবে না বলেও আশা প্রকাশ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শিক্ষক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, পর্যবেক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের সঙ্গে সংলাপ করেছিলো। এতে উঠে আসা সুপারিশের বিষয়ে ইসির তার অবস্থান এখনো জানায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ইভিএম প্রসঙ্গে আসা সুপারিশের বিষয়ে সিইসি গতকাল তার মতামতে বলেন, ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি এবং সমর্থন দুই-ই রয়েছে। কমিশন তা শুনে মতবিনিময় করেছে। ইভিএম’র ব্যবহার নিয়ে ইতোপূর্বে সব দলের (কতিপয় দল অংশগ্রহণ করেনি) আমন্ত্রিত প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংলাপ ও কর্মশালা হয়েছে। এছাড়া বুয়েটসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি বিষয়ে বিশিষ্ট অধ্যাপকদের অংশগ্রহণে একাধিক সংলাপ ও কর্মশালা হয়েছে। যেহেতু সদ্যসমাপ্ত রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইতিপূর্বে ইভিএম নিয়ে আরও সংলাপ, কর্মশালা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এবং কমিশন ইভিএম-এর সার্বিক বিষয়ে এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এটি নিয়ে কর্মশালা, মতবিনিময়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তার সার্বিক ফলাফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম-এর ব্যবহার বিষয়ে কমিশন যথাসময়ে অবহিত করবে। তিনি বলেন, ব্লক চেইন পদ্ধতিতে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসে ই-ভোট প্রদানের প্রস্তাবটি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রয়োগ সম্ভব নয়। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগে এ বিষয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা বা সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

সংলাপে বেশিরভাগ দল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে উল্লেখ করে এ বিষয়ে ইসি তার মতামতও জানিয়েছে। এ বিষয়ে ইসি বলেছে, নির্বাচন কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াস নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করবে না। তবে সব দলকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান শেষ পর্যন্ত আন্তরিকভাবেই বহাল থাকবে।

সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সুপারিশ করেছিলো। এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ইসি। নির্বাচনের সময়ে চারটি মন্ত্রণালয়-জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা অধীনে রাখার সুপারিশের বিষয়ে ইসি বলেছে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।

নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বাধা ও বিরোধীদের নামে মিথ্য মামলা দায়েরের বিষয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটি ধারণা বা বিশ্বাস প্রবল আছে বলে কমিশন মনে করে। কমিশন দৃঢ়ভাবে আরও বিশ্বাস করতে চায় সরকারি দল এ ধরনের নির্বাচন আচরণবিধি ভাঙার মতো কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং রাজনৈতিক কারণে কোনো মামলা করে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার পথ বন্ধ করবে না। এক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সব অংশীজনের কার্যকলাপ কমিশন গভীর পর্যবেক্ষণে রাখবে।

অন্যান্য মতামতের বিষয়ে ইসি জানিয়েছে, সঠিক ফলাফল নিশ্চিতকরণ, পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ সংক্রান্ত দলগুলোর প্রস্তাবের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তার বক্তব্য তুলে ধরেছে। এতে বলা আছে সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের অধীনে দেয়া সব ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ভোটাধিকার প্রয়োগে সব বাধা অপসারণের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িংফিল্ড প্রতিষ্ঠা করবে। সেই সঙ্গে কারচুপির সম্ভাব্য সব সুযোগ প্রতিরোধ করে সঠিক ও নিরপেক্ষ ফলাফল নিশ্চিত করতে সততা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কমিশন কাজ করে যাবে। কমিশন বলেছে, নির্বাচনে জয়-পরাজয় অনিবার্য। প্রার্থীদের জয়-পরাজয় মেনে নিতে হবে। পরাজয় মেনে না নেয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে।

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে ইসি বলেছে, দেশে একইদিনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। এতে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকাজে নিয়োজিত অসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা অপর্যাপ্ত বা অপ্রতুল হতে পারে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকাজে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাবনাটি যৌক্তিক বলে কমিশন মনে করে।

অন্যান্য মতামতের বিষয়ে বলা হয়েছে, সুযোগ ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল, এক মঞ্চে প্রচার ও ঋণখেলাপির বিষয়ে বলা হয়েছে। একই মঞ্চ থেকে সব দলের প্রার্থীদের বক্তব্য দানের এবং প্রচারণার নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করার, নির্ধারিত স্থানে সব প্রার্থীর পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে একই পোস্টারে সব প্রার্থীর প্রচারণার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব আধুনিক। এতে নির্বাচনি ব্যয় কমে আসতে পারে। নির্বাচনি সহিংসতা হ্রাস পেতে পারে। রাজনীতিতে সম্প্রীতির নতুন সংস্কৃতির প্রচলন হতে পারে। তবে এ বিষয়ে ইসি কী পদক্ষেপ নেবে তা স্পষ্ট করেনি। সংখ্যানুপাতিক সংসদীয় ব্যবস্থার সুপারিশের বিষয়ে সিইসি জানান, প্রস্তাবটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকার এবং জাতীয় সংসদের এখতিয়ারাধীন বলে কমিশন মনে করে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More