এ বীভৎসতার শেষ কোথায় : বিবস্ত্র করে নারীর ভিডিও ফেসবুকে নোয়াখালীর নিষ্ঠুর ঘটনায় চারজন আটক : ক্ষোভে ফুঁসছে সারাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বিবস্ত্র করে নারীর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ভাইরাল করার পর ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসছে রাজধানী ও নোয়াখালীসহ সারাদেশ। রীতিমতো প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। বসে নেই উচ্চ ও নি¤œ আদালতও। বেগমগঞ্জ মডেল থানায় ৭-৮ জন অজ্ঞাতসহ ৯ জনের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেছেন নির্যাতিত নারী। এরইমধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোমবার দুই আসামিকে দুই মামলায় ছয় দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন নোয়াখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

একইদিন গৃহবধূকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে ভিডিওটি পেনড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ওই নারীর নিরাপত্তা, জবানবন্দি নেয়া, দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কি না, তা অনুসন্ধানে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। জেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা ও চৌমুহনী সরকারি এসএ কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। নির্যাতনের এ ঘটনা সোমবার নজরে আনার পর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন। তদন্ত কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে হাইকোর্টের রেজিস্টারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ওই ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সবশেষ অবস্থা জানিয়ে ২৮ অক্টোবর আদালতকে প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুনানিতে আদালত বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ায় টনক নড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। রোববার (৪ অক্টোবর) দুপুরের দিকে ঘটনার ৩২ দিন পর গৃহবধূকে নির্যাতনের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ পেলে তা ভাইরাল হয়-টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের। ঘটনার পর থেকে গত ৩২ দিন অভিযুক্ত স্থানীয় দেলোয়ার, বাদল, কালাম ও তাদের সহযোগিরা নির্যাতিত গৃহবধূর পরিবারকে কিছুদিন অবরুদ্ধ করে রাখে। একপর্যায়ে তার পুরো পরিবারকে বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করলে পুরো ঘটনা দীর্ঘদিন স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসনের অগোচরে থাকে।

সোমবার বেগমগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদের আবেদনে নোয়াখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট নবনীতা গুহ ভিকটিমের ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি দেয়ার সময় ভিকটিম বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ করে জানান, অপরাধীরা সবসময় তাকে কুপ্রস্তাব দিতো। রাজি না হওয়ায় ঘটনার দিন এজাহারে উল্লিখিত সন্ত্রাসীরাসহ আরও ৭-৮ জন সন্ত্রাসী রাতে লাথি মেরে তার ঘরের দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। তার স্বামীকে পাশের ঘরে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তিনি বাধা দিলে সন্ত্রাসীরা তাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তার বিবস্ত্র শরীরের ছবি ভিডিও করে। এ সময় তিনি চিৎকার শুরু করলে তারা চলে যাওয়ার সময় বলে যায় কাউকে কিছু বললে তাকে মেরেই ফেলবে এবং এ ছবি ভাইরাল করে দেবে।

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূ গণধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে-না-কাটতে রোববার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর সোমবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ ও ধর্ষকদের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে। এসব প্রতিবাদ সমাবেশে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায় সর্বস্তরের মানুষ। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের প্রতিটি নারী ও শিশু সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার মাত্রা, ধরন ও নিষ্ঠুরতা বেড়েছে বহুগুণ। এর মূল কারণ নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ। নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতি একদিকে নারীকে নিপীড়ন করার প্রবণতা তৈরি করে, অন্যদিকে নিপীড়িত নারীকেই দোষারোপ করে। বক্তারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তাঘাট, বাজার, কর্মস্থল ও বাড়িঘর-কোথাও আজ নারী-শিশুরা নিরাপদ নয়। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। অবুঝ শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এর থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, জড়িতদের শাস্তি না দিলে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে দেশ। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী নোয়াখালীর এ ঘটনা আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাসপুরের জয়কৃষ্ণপুরে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টায় বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় বেগমগঞ্জ থানায় মামলা হয়। সোমবার সকালে মামলার ১নং আসামি বাদলকে ঢাকা থেকে ও স্থানীয় দূর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং লিডার ও দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করে র‌্যাব-১১।

আটক বাদল (২২) একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মধ্যম একলাশপুর গ্রামের মোহর আলী মুন্সিবাড়ির রহমত উল্যার ছেলে, দেলোয়ার একই গ্রামের কামাল উদ্দিন ব্যাপারী বাড়ির সাইদুল হকের ছেলে।

এদিকে নির্যাতিত নারী বাদী হয়ে সোমবার রাতে নয়জনকে আসামি করে এবং ৭-৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে বেগমগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু ঘটনার মূলনায়ক ও এলাকার কিশোর গ্যাং কমান্ডার দেলোয়ারের নাম মামলার এজাহারে আসেনি বলে এলাকাবাসী হতবাক হয়েছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ ও র‌্যাব তিন দফায় অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে আটক করে।

পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তিরা হলো একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের খালপাড় এলাকার হারিদন ভূঁইয়াবাড়ির শেখ আহম্মদ দুলালের ছেলে মো. রহীম (২০) ও একই এলাকার মোহর আলী মুন্সিবাড়ির মৃত আবদুর রহীমের ছেলে মো. রহমত উল্যাহ (৪১)।

মামলার এজাহারে বলা হয়: ২ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকার নূর ইসলাম মিয়ার বাড়িতে গৃহবধূর (৩৫) বসতঘরে ঢুকে তার স্বামীকে পাশের কক্ষে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে শ্লীলতাহানি করে স্থানীয় দেলোয়ার, বাদল ও তাদের সংঘবদ্ধ বখাটে যুবক দল। ওই সময় গৃহবধূ বাধা দিলে তারা তাকে বিবস্ত্র করে তার লজ্জাস্থানে হাত ঢুকিয়ে দেয় ও বেধড়ক মারধর করে মোবাইলে ভিডিওচিত্র ধারণ করে। তাদের হাত থেকে বেঁচে তিনি তার স্বামীকে নিয়ে মাইজদী শহরের হাউজিং এলাকায় তার বোনের বাসায় আশ্রয় নেন। রোববার দুপুরে ওই সন্ত্রাসীরা তাকে ফোন করে আবারও কুপ্রস্তাব দেয় এবং হুমকি দেয়-তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে তারা মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। নির্যাতিতা রাজি না হওয়ায় রোববার তারা ওই নারীর বিবস্ত্র ছবি ভাইরাল করে দেয়। এ ছবি পেয়ে সাংবাদিকরা খোঁজখবর নেয়া শুরু করলে পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়ে।

বেগমগঞ্জ মডেল থানার ওসি মো. হারুন উর রশীদ জানান, পুলিশ অভিযুক্ত অপর আসামিদের গ্রেফতারে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। আটককৃত আসামিদের বিচারিক আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্যাতিতার পিতা বলেন, আমরা গরিব মানুষ তাদের ভয়ে এ একমাস কাউকে কিছু বলিনি। কারণ তারা সরকারি দলের নেতা, কেউ আওয়ামী লীগের, কেউ যুবলীগের। তাদের রয়েছে ইয়াবা বেচার নগদ টাকা, অস্ত্র, ক্যাডার বাহিনী। তারা নেতা, এমপিদের সঙ্গে ছবি তোলে, আমরা তাদের কী করবো। স্থানীয় ওয়ার্ডের সোহাগ মেম্বার ও স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের চেয়ারম্যান ও এ বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ বাহিনী গত ৬ মাসে এলাকায় ৭-৮ জন দরিদ্র নারীকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এ কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পূর্বে রিপোর্ট হলেও পুলিশ তা আমলে না নেয়ায় এ দেলোয়ার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তার এ বাহিনীতে রয়েছে ৫০-৬০ জনের সক্রিয় সদস্য। তারা নিজেদের আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা বলে পরিচয় দিয়ে ব্যানার, ফেস্টুন দিলেও শাসক দল কখনও আপত্তি করেনি। নেতা-এমপিদের সঙ্গে ছবি দিয়ে ব্যানার থাকায় পুলিশ ও তাদের সমীহ করে চলতে দেখা গেছে। এমনকি চন্দ্রগঞ্জে পুলিশের ওপর ও একলাসপুরে ডিবি পুলিশের ওপর মাদক কারবারিরা হামলা করে পুলিশকে মারধর করে আহত করলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় এ সব বাহিনীর সাহস বেড়ে গেছে বলে জেলার অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।

নারী নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন জানায়, এ পর্যন্ত ৪ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিকটিমকে উদ্ধার করে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More