কমেছে পাশের হার ও জিপিএ-৫ : তবুও কমতি নেই উচ্ছ্বাসে

স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ফল ভালো : আগের মতো ইংরেজিতে অকৃতকার্যের হার বেশি

স্টাফ রিপোর্টার: এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত বছরের চেয়ে এবার পাশের হার এবং জিপিএ-৫ উভয়ই কমেছে। এরপরও আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কমতি ছিল না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের। তাদের মতে, গতবার পরীক্ষা হয়েছে তিন বিষয়ে, এ বছর ১২টিতে। এছাড়া লেখাপড়ার জন্য কার্যকর অর্থে সময় পেয়েছে নির্ধারিত দুই বছরের পরিবর্তে এক বছর। তাই শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। সেই হিসাবে পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে। তবে বরাবরের মতো শিক্ষার্থীদের কাছে কঠিন বিষয় হিসাবে চিহ্নিত ইংরেজিতে অকৃতকার্যের হার তুলনামূলক বেশি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ফলাফলের ওপর। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৫৭ দিনের মাথায় বুধবার এ ফল প্রকাশ করা হয়। এইচএসসি, আলিম এবং এইচএসসি (বিএম-ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) ও ডিপ্লোমা ইন কমার্স পরীক্ষা এবারও ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নেয়া হয়। সব মিলে পাশের হার ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ শিক্ষার্থী। গত বছর ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। অর্থাৎ পাশের হার কমেছে ৯.৩১ শতাংশ আর জিপিএ-৫ কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭টি। বুধবার দুপুর ১টায় রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে (আমাই) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তবে এর আগে বেলা ১১টার দিকে ফলপ্রকাশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ৫২ মিনিট পর শিক্ষার্থীদের জন্য ওয়েবসাইট এবং এসএমএসসহ ডিজিটাল মাধ্যমে ফল জানার ব্যবস্থা উন্মুক্ত করা হয়। পাশাপাশি একই সময়ে নিজ নিজ কলেজ ও মাদ্রাসা থেকেও শিক্ষার্থীরা ফল জানতে পেরেছে। আনুষ্ঠানিক ফলপ্রকাশ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিবসহ বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, গত বছরের চেয়ে এবারে পাশের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এবারে শিক্ষার্থীরা ১২ বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। গত বছর আরও কম বিষয় ছিল। তারপরও বলব, সবাই ভালো করতে পারেনি। যারা অকৃতকার্য হয়েছে তাদের হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নবোদ্যমে পূর্ণ প্রস্তুতিতে আগামীতে পরীক্ষা দিয়ে তোমরা সফলকাম হবে।’ এ সময় তিনি কৃতকার্য শিক্ষার্থী, তাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, স্বপ্নের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার ইতিবাচক মানসিকতা পোষণ এবং গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১১টি শিক্ষা বোর্ডে এবার মোট পরীক্ষা দেয় ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৭ জন। পাশ করেছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৮৭ জন। অন্যদিকে আলাদাভাবে কেবল ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষা দেয় ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ জন। তাদের মধ্যে ৮ লাখ ১৭ হাজার ২৩০ জন পাশ করেছে। পাশের হার ৮৪.৩১ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন। গত ৬ নভেম্বর সারা দেশে এই পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকের এই পরীক্ষার্থীরা ‘করোনার ব্যাচ’ হিসাবে পরিচিত। কেননা ২০২০ সালে তাদের এসএসসি পরীক্ষা শেষ করার পরপরই দেশে করোনার কারণে ‘লকডাউন’ শুরু হয়ে যায়। এ কারণে তখন যথাসময়ে তাদের ফলপ্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সাধারণত ১ জুলাই একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু কোভিড মহামারির ডামাডোলে ওই বছর নির্ধারিত সময়ের তিন মাস পর ৩ অক্টোবর তাদের ক্লাস শুরু হয়। তাও সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি। এ সময়ে অনলাইন আর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক লেখাপড়াই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। এ অবস্থায় প্রথম বর্ষ কেটে যায়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পুরোপুরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে তারা দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে ক্লাসে বসে। আর এই বাস্তবতা সামনে রেখে তাদের সিলেবাস পুনর্বিন্যাস করে ছোট করা হয়েছিল। এরপরও এবার শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১০ গুণ বেড়ে ৫০টি হয়েছে। ছাত্রদের তুলনায় এবারও পাশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক থেকে ছাত্রীরা এগিয়ে আছে।

ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোয় ইংরেজিতে গড়ে ১২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পাশের হার কুমিল্লা বোর্ডে ৯৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বোর্ডে ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। অন্যদিকে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৯০ শতাংশের ওপরে। ইংরেজি বিষয়ে ফল ভালো হওয়ার কারণেই মূলত এ দুটি বোর্ডের সার্বিক ফল ভালো হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ইংরেজিতে পাশের হার যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ৭৭ ও ৯৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

এছাড়া ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের। পাশের হার ৭৯ দশমিক ০৮ শতাংশ। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাশের হার ৮৫.৩৭ শতাংশ, যা সারা দেশে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। পদার্থ, রসায়ন ও হিসাব বিজ্ঞানেও এই বোর্ডে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাশের হার সর্বনিম্ন। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ৮৮.৩৬, ৯১.২৩ এবং ৭৯.৯৬ শতাংশ। সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সারা দেশে ইংরেজিতে এবার সর্বোচ্চ পাশের হার ময়মনসিংহ বোর্ডে ৮২.০৫ শতাংশ। সাধারণত যেসব বোর্ডের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভালো করে, সেই বোর্ডের পাশের হারও বেড়ে যায়। এমনটি ঘটেছে কুমিল্লা বোর্ডের ক্ষেত্রে। সারা দেশে সর্বনিম্ন পাশের হার এই বোর্ডে। বোর্ডটিতে পদার্থ বিজ্ঞানে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৮.০৮ এবং রসায়নে ৯৭.৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতেও পাশের হার সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৪.৬৪ শতাংশ। হিসাববিজ্ঞানে দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক ৯৭.৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে কুমিল¬া বোর্ডে। তাই সহজেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিষয়ভিত্তিক পাশের হার সার্বিক পাশের হারে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে।

অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় এবার অধিকসংখ্যক বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ায় ফল এবার তুলনামূলক খারাপ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গত বছরের (২০২১) ফলের সঙ্গে এবারের (২০২২) পাশের হার ও জিপিএ-৫ এর তুলনা করা চলে না। কেননা, গত বছর বাংলা-ইংরেজির মতো বিষয় বাদ রেখে শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি করে ঐচ্ছিক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো। অবশিষ্ট বিষয়ে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে গ্রেড দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। যে কারণে তাদের পাশের হার ৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়। অপরদিকে এবারে ১৩টির মধ্যে ১২ বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। সিলেবাস ছোট করায় পরীক্ষার নম্বর ও সময় কমানো হয়। ৫০ শতাংশ নম্বরে পরীক্ষা নিলেও তা শতভাগ নম্বরে রূপান্তর করে ফল তৈরি করা হয়েছে। শুধু পরীক্ষা থেকে আইসিটি বিষয়টি বাদ দেয়া হয়। এই বিষয়ে জেএসসি এবং এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়। এক্ষেত্রে জেএসসির ওপর ২৫ আর এসএসসির প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ৭৫ শতাংশ জোর দেওয়া হয়। তবে করোনার আগে সর্বশেষ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এইচএসসির শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় ২০১৯ সালে। ওই বছর মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ দশ বোর্ডে মোট পাশের হার ছিল ৭৩.৯৩ শতাংশ। এরমধ্যে শুধু সাধারণ শিক্ষা বা এইচএসসিতে পাশের হার ছিল ৭১.৮৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪১ হাজার ৮০৭ জন। এই হিসাবে এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ অনেক বেড়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আইটি বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবীর বলেন, এই ব্যাচটির ফলাফল এসএসসির তুলনায় ভালো হয়েছে। কেননা, ২০২০ সালে এগারো বোর্ডে এসএসসিতে পাশের হার ছিল ৮২.৮৭ শতাংশ। যাদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষায় শুধু এসএসসিতে পাশের হার ছিল ৮৩.৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে ১১ বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। তাই দেখা যাচ্ছে, এই ব্যাচটি ২ বছর পর উচ্চ মাধ্যমিকে এসে ভালো করেছে। তাদের পাশের হার এবং জিপিএ-৫ উভয় বেড়েছে।

শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, এবারের ব্যাচটি করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রভাবটাও সবচেয়ে বেশি পড়েছে তাদের ওপর। কেননা, এক বছরের বেশিদিন তারা ঘরবন্দি ছিল। ক্লাসের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে অতিরিক্ত লেখাপড়ার যে সুযোগ সেটা তারা পায়নি। এরপর আবার গত বছরের তুলনায় এবারে বেশি সংখ্যক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাদের। তাই গত বছরের চেয়ে এবারে ‘কোয়ালিটি রেজাল্ট’ কিছুটা কমতেই পারে। কিন্তু এসএসসির তুলনায় এই ব্যাচে এবারে পাশের হার বেশি। এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসসহ অন্যান্য কয়েকটি দিকে তারা বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, গত বছর বিভাগভিত্তিক ঐচ্ছিক বিষয়ে পরীক্ষা নেয়ায় বাংলা-ইংরেজির মতো বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি। সাধারণত ইংরেজি অনেকের কাছে কঠিন বিষয়। এতে বড় একটা অংশ অকৃতকার্য হয়। গত বছর ইংরেজির বাধা না থাকায় পাশের হারও বেশি ছিলো।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More