করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ : বুয়েট-রাবিসহ কয়েকটিতে করোনার হানা

সন্তান স্কুল-কলেজে পাঠাতে শঙ্কায় অভিভাবকরা
স্টাফ রিপোর্টার: করোনাভাইরাসে সংক্রমণ অনেকটাই লাফিয়ে বাড়ছে। ৩ জানুয়ারি যেখানে সন্দেহজনক রোগীর মধ্যে আক্রান্ত ছিল ৩ শতাংশ, সেখানে বৃহস্পতিবার এই হার দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় অভিভাবকদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা গণমাধ্যমে ফোন করে জানতে চান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা। তবে পরিস্থিতি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যাপারে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যাপারে সরকার এখনই কোনো সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না বলে ইতোমধ্যে একাধিকবার জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সর্বশেষ ডিসি সম্মেলন থেকে বেরিয়ে তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। অনসাইটের পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমও চলবে। ওইদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়েও উপাচার্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেখানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে লেখাপড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সরকারি মনোভাবের কথা জানিয়ে দেন। পাশাপাশি পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শও দেন তিনি। সে ক্ষেত্রে, ক্যাম্পাস পুরোপুরি খোলা রাখা কিংবা বন্ধ করা অথবা অনলাইন-অনসাইটের সমন্বয়ে হাইব্রিড পদ্ধতিও প্রয়োগ করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারিগরি সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লাহ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে করোনা সংক্রমণের বড় ধরনের কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সার্বিকভাবে মৃত্যুর হার কম। টিকাদানের অবস্থাও ভালো। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। অন্যদিকে এমনিতে দেড় বছরের ছুটিতে জাতীয়ভাবে শিক্ষার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। এই ক্ষতি রোধ করতে হবে। তাই সবমিলে মনে করছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি দেয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে পারে বলে মনে করছি। এরপরও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে। দু-একদিনের মধ্যে মিটিংয়ের দিনক্ষণ জানা যাবে।
বর্তমানে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু আছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকটাই স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। আর প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রতিষ্ঠানে ভাগ করে ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকাজ চলছে। এরমধ্যে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ছাত্রছাত্রীরা সপ্তাহে ৫-৬ দিন স্কুলে যাচ্ছে। আর বাকিরা সপ্তাহে দুদিন যাচ্ছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে হু-হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে একাডেমিক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি অনলাইনে চলে যাচ্ছে। আবার কোনোটি সরাসরি কার্যক্রম চালানোর কথা জানাচ্ছে। আর আগের মতো অনলাইন-অনসাইট পদ্ধতির সংমিশ্রণে চলার কথাও জানাচ্ছে। অবশ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এর একটি রাজধানীর বকশিবাজারের অগ্রগামী শিশু নিকেতন। প্রতিষ্ঠানটি বৃহস্পতিবার নোটিশ দিয়ে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সরাসরি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। অবশ্য এ সময়ে অনলাইনে ক্লাস নেবে তারা।
করোনা পরিস্থিতি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যাপারে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। রাইয়ান আকবর নামে লালবাগের এক অভিভাবক বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা উচিত। কেননা আগে সন্তানের জীবন পরে লেখাপড়া। বেঁচে থাকলে লেখাপড়া হবে। আর আব্দুল্লাহ আল মতিন নামে ধানমন্ডির এক অভিভাবক বলেন, যে লক্ষ্যে স্কুল বন্ধ করা হয় সেটা অর্জিত হয় না। কেননা ছেলেমেয়েরা ঘরে থাকে না। বরং স্কুলে গেলে বা অনলাইনে ক্লাস চললে তারা একটা রুটিনে থাকে। এটাই ভালো।
এদিকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ১৯ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৮ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পান্ডে নিশ্চিত করেছেন। এই ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সংক্রমণ বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস চলবে। সভায় বিভাগীয় সভাপতি ও বিভিন্ন অনুষদের ডিনরা উপস্থিত ছিলেন। পরে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, এখনই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে চাচ্ছি না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস চলবে। তবে কোনো বিভাগ যদি মনে করে অনলাইনে ক্লাস নেবে, তাহলে সেই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
করোনা সংক্রমণ হয়েছে বুয়েটের আবাসিক হলেও। গত ১১ জানুয়ারির খবর হচ্ছে, আটটি আবাসিক হলে ২৪ জন শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। পরদিন বুয়েট একাডেমিক কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনার ঘোষণা দেয়। ১৫ জানুয়ারি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে।
বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনার ঘোষণা দেয়। তবে ১৩ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, ৩০ জানুয়ারি থেকে প্রথমবর্ষের ক্লাস সশরীরে শুরু হবে। ইতোমধ্যে ১৬ জানুয়ারি অন্যান্য সব বর্ষের প্রথম টার্মের ক্লাস সশরীরে শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীর করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়া হয়েছে বলেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন। এর আগের দিন একইভাবে অনলাইনের পরিবর্তে সশরীরে ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো ইমদাদুল হকের সভাপতিত্বে ‘ক্লাস গ্রহণ’ সংক্রান্ত এক সভায় এ সিদ্ধান্তটি হয় যেখানে একাধিক ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন রবীন্দ্রনাথ ম-ল সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। সেশন দূর করার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীতকালীন ছুটি কমানো হয়েছে। আর বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চলবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখার ক্ষেত্রে সরকার দুটি দিকে নজর দিয়েছে। এর একটি হচ্ছে- শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার প্রণীত প্রমিত স্বাস্থ্যবিধি (এসওপি) নিশ্চিত করা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এসব নিশ্চিতে তদারকির পাশাপাশি দৈনিক সংক্রমণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সারাদেশে শিক্ষা প্রশাসনকে তৎপর করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য মঙ্গলবার উপাচার্যদের নিয়ে খোদ শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করেন। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা টিকা দেয়নি তাদের দ্রুত টিকার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠক থেকে উপাচার্যরা পরামর্শ দিয়েছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে তাদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী আশ্বাস দেন।
জানা গেছে, সারা দেশে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২২ জন টিকা পাওয়ার উপযোগী আছে। এদের মধ্যে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৭ লাখ ১৮ হাজার ৩৩৭ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া শেষ হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More