করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড ভাঙছে : সামনে ভয়াবহ অবস্থা আসছে

স্টাফ রিপোর্টার: মহামারির দেড় বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়কর অবস্থা চলছে এখন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন দিয়ে রাখলেও সংক্রমণ ও মৃত্যু কোনোটিই কমছে না। ঈদের আগে লকডাউনে বিরতি দেয়ায় ঝুঁকির কথা বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তা ভয়ংকরভাবে সত্যি করে একই দিনে পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙে দিল শনাক্ত কোভিড রোগী আর মৃত্যুর সংখ্যা। গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫০ হাজার ৯৫২টি নমুনা পরীক্ষা করে রেকর্ড ১৫ হাজার ১৯২ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। একই সময়ে রেকর্ড ২৪৭ জনের প্রাণ গেছে এ ভাইরাসের কারণে। গত বছরের মার্চে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর এক দিনে এর চেয়ে বেশি রোগী আর কখনো শনাক্ত হয়নি, এত মৃত্যুও আর কখনো দেখতে হয়নি বাংলাদেশের মানুষকে। গত সাত দিনে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে ৬২ হাজার ৫১৭ জন শনাক্ত এবং ১ হাজার ৩৯৬ জন মারা গেছেন। গত এক দিনে শুধু ঢাকা বিভাগেই ৭ হাজার ৯৫৩ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা দিনের মোট আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি। আর এই সময়ে যে ২৪৭ জন মারা গেছেন, তাদের ৭২ জনই ছিলেন ঢাকা বিভাগের। চট্টগ্রাম বিভাগে ৬১ জন এবং খুলনা বিভাগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিসহ বিশেষজ্ঞরা করোনার সংক্রমণ রোধে যেসব পরামর্শ শুরুতে দিয়ে আসছিলেন এবং কোরবানির ঈদ সামনে রেখে যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার সিংহভাগই মানা হয়নি। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করায় মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, করোনা ভাইরাস ঊর্ধ্বমুখীর এই সময়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া বন্ধ রাখা গেলে সংক্রমণ কিছুটা রোধ করা যেত। সামনে কঠিন অবস্থা আসছে। এখন শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে করোনার নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। সবাইকে টেস্টের আওতায় আনতে হবে। এর মাধ্যমে অচিহ্নিতরা চিহ্নিত হয়ে যাবে। আর ব্যাপক ভিত্তিতে করোনার টিকাদান কার্যক্রম চালাতে হবে। টিকা নেয়ার ব্যাপারে সরলীকরণ করতে হবে। গ্রামের অনেক মানুষ টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে যে নিবন্ধন করতে হয় সে বিষয়টি জানেন না। তারা এনআইডি কিংবা অন্য কোনো পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে গেলে টিকা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এখনই করোনার চিকিৎসাসেবা সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর সক্ষমতা বেশি থাকার পরও করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে।
সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, এখন হাত ধোয়ার দিন শেষ। চিকিৎসাসেবায় গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো হাসপাতালে বেড খালি নেই। ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করে চিকিত্সাসেবার ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে প্রাণহানি আরো বাড়বে। সামনে ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটিই বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে বেড বাড়িয়ে লাভ নেই। করোনার কমিউনিটি সংক্রমণ কমাতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা মাস্ক পরবে না, তাদের বয়কট করতে হবে, সম্মান করা যাবে না। নতুন আক্রান্তদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৭। আর আক্রান্তদের মধ্যে মোট ১৯ হাজার ৫২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
শনাক্ত ও মৃত্যু হু হু করে বাড়তে থাকায় গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। তবে তাতে সংক্রমণের বিস্তারে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি। বিধিনিষেধের মধ্যেই ৬ জুলাই প্রথমবারের মতো দৈনিক শনাক্ত রোগী ১০ হাজার ছাড়ায়। তারপর ১২ জুলাই ১৩ হাজার ৭৬৮ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এটাই ছিল এত দিন সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড। গতকাল সেই রেকর্ডও ভেঙে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ১৫ জুলাই থেকে লকডাউন শিথিল করে বলা হয়, ঈদের ছুটির পর আবার কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হবে। অফিস-আদালত, হাট-বাজার, যানবাহন সবই চলেছে এই ৯ দিনে, গাদগাদি করে মানুষ গ্রামে গেছে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ তখন বলেছিলেন, দেশে যখন করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, তখন সব বিধিনিষেধ তুলে নেয়ায় সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হলো। ঈদের ছুটির মধ্যে দৈনিক নমুনা পরীক্ষা কমে যাওয়ায় প্রতিদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও কমে গিয়েছিল। নমুনা পরীক্ষা বাড়ায় রবিবার শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ফের ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়; সেই সঙ্গে মৃত্যু হয় সোয়া দুই শ মানুষের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় গতকাল দৈনিক শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৮২ শতাংশে, যা আগের দিন ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ ছিল।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More