কারসাজিতে দাম বৃদ্ধি কমানোর নামে প্রবঞ্চনা : ভোক্তার সঙ্গে ভাঁওতাবাজি

প্রায় প্রতিনিয়ত ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট

স্টাফ রিপোর্টার: পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে ভাঁওতাবাজি চলছে। কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয় পণ্যের দাম। পরে চাপের মুখে কমে খুবই সামান্য। ফলে বাড়তি দামেই বিক্রি হয় পণ্য। এরপর ফের দাম বাড়ানো হয়। এবার সেই বাড়তি দামের সঙ্গে নতুন দর যোগ করে বিক্রি হয় প্রয়োজনীয় দ্রব্য। একইভাবে বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে দেশেও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশে কমানো হয় না। সেসময় নানা অজুহাতে বাড়তি দামেই বিক্রি হয়। শুল্কছাড়, এলসি মার্জিন হ্রাসসহ সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা নেয়ার পরও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। এভাবে প্রায় প্রতিনিয়ত ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।

সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিলেও বাজারে সেই দর কার্যকর হয়নি। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে মূল্য বেড়েছে। আর দাম কমালে ব্যবসায়ীরা কমায়নি। তখন ডলার ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করা হয়েছে। পাশাপাশি রোজা ঘিরে সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও অসাধুরা কারসাজি করে দুই মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।

মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তার জন্য দেয়া ছাড় ক্রেতার কাছে পৌঁছে না বললেই চলে। সুবিধার বড় অংশই চলে যায় ব্যবসায়ী ও কথিত সিন্ডিকেটের পকেটে। সরকারের প্রশাসন-যন্ত্র দিয়ে এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দেশে ডলারের সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি-এসব কারণে রোজা উপলক্ষ্যে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন খাতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এরপরও ওইসব ছাড়ের সুবিধা ভোক্তা পাচ্ছে না। একই সঙ্গে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে পণ্য মিলছে না। বেশি দামে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার কী করছে, তা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে। অনিয়ম করলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ভোক্তা সরকারের উদ্যোগের সুফল পাবে। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না।

জানা যায়, এবারের রোজা উপলক্ষ্যে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে আমদানির ক্ষেত্রে চিনি ও সয়াবিনের শুল্কছাড় দেওয়া হয়। এতে বাজারে প্রতি কেজিতে চিনির দাম ৫ টাকা এবং ভোজ্য তেল প্রতি লিটারে ৭ টাকা কমার কথা। বাস্তবে তা কমেনি। আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১০২ থেকে ১০৩ টাকা করে ডলারের জোগান দিয়েছে। বাজারে এসব ডলার কিনতে ব্যয় করতে হয় ১২০ টাকা। এতো কম দামে ডলার পেয়েও পণ্যের দাম কমানো হয়নি। গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাহাজ ভাড়া যেভাবে বেড়েছিল, তা গত নভেম্বরে প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। এর প্রভাবও বাজারে পড়েনি। এসব পদক্ষেপের ফলে পণ্যের আমদানি খরচ কমেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়েছে।

আইএমএফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজ ভাড়া কমার কারণে মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ১ শতাংশ কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত কয়েক বছর রোজায় পণ্যের দাম বাড়ছে না। কিন্তু রমজান ঘিরে রোজা শুরু হওয়ার দুই মাস আগেই সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে দেখা যাচ্ছে, ক্রেতার চাহিদা কমায় রোজার প্রথম সপ্তাহে কিছু পণ্যের দাম কমছে। আর সেটা সংশ্লিষ্টরা এর ক্রেডিট নিয়ে বলছে, তদারকি জোরদার করায় পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও ক্রেতাকে বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে। এটা একধরনের ভাঁওতাবাজি। এখান থেকে ক্রেতাকে মুক্ত করা দরকার।

বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম বাড়ানো হলে বা আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু কমানোর ক্ষেত্রে এটি কমে না। বলা হয়, কম দামের পণ্য দেশে এলে কমবে। কিন্তু দেশে কমলেও যে হারে কমার কথা, সে হারে কমে না। এ বিষয়টি তদারকি করে ভোক্তার অধিকার রক্ষার পদক্ষেপও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় না। গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম কমে যায়, তখন ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেল ও চিনির দাম কমায়নি। উলটো ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়েছে। গত দুই মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম কেজিতে ২০ টাকা বাড়িয়ে ১০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার পর সম্প্রতি কেজিতে ৫-১০ টাকা কমানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাজারে এখন পণ্যটি কেজিতে ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম কমানোর পরও ক্রেতার ১০-১৫ টাকা বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়। রোজার শুরুতে ৫ টাকা কমিয়ে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি কিনতে ক্রেতার এখনো কেজিতে ১০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রতি কেজি ১৬০ টাকা দরের ব্রয়লার ও মুরগি রোজা শুরুর দুই মাস আগেই ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ২৬০ টাকা পর্যন্ত ওঠানো হয়। সোমবার প্রতি কেজি ২২০ টাকায় বিক্রি হয়। এরপরও কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগি কিনতে ক্রেতার ৬০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে দেশের পোলট্রি খাতে। এই খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে মুরগির দাম বৃদ্ধির পেছনে যারা জড়িত, তাদের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চিহ্নিত করে শাস্তির নজির নেই।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ জানুয়ারি প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সেসময় থেকে এখন পর্যন্ত বাজারে এই দামে চিনি পাওয়া যায়নি। খচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা, যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৩-২৩ টাকা বেশি। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৫ টাকা কমিয়ে ১৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা।

রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। বর্তমানে বেগুন ৫০-৬০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজি ও বুট বাজারে আগের থেকে দাম অনেক কম রয়েছে। মানুষ বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র একবারে কিনে নিচ্ছে। ফলে বাজারে গিয়ে মানুষ ভাবছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হয়েছে। এছাড়াও গত বছর থেকেও এবার সব পণ্যের সাপ্লাই অনেক রয়েছে। কোনো পণ্য সংকট হওয়ার শঙ্কা নেই।

সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এসে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, রোজায় কিছু পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা বেড়ে যায়। তাই দুই থেকে তিন মাস আগে আমদানি পণ্যের মজুত ঠিক রাখার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এলসির সমস্যা দূর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বসে সমাধানের চেষ্টা করেছি। এছাড়া বাজারে পণ্যের কোনো সংকট নেই। বাজারে পণ্য কিনতে এসে ক্রেতা কিনতে পারছে। তবে দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখতে পারিনি। সেটার কারণ হচ্ছে-ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে কিছুটা যৌক্তিক ও কিছুটা অযৌক্তিক। এজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তাই রোজা শুরুর আগেই ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসে মিটিং করেছি। এফবিসিসিআইসহ বাজার কমিটিকে নিয়ে বসেছিলাম, যাতে দাম কমানো যায়। পাশাপাশি বাজারে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। তবে কিছু পণ্যের দাম আগেই বেড়েছে। এখন কমতির দিকে আছে। আমরা সজাগ আছি কেউ যাতে পণ্য মজুত করে দাম না বাড়াতে পারে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More