কোচিং ও সহায়ক বই বৈধতা দিয়েই শিক্ষা আইন

স্টাফ রিপোর্টার: বাণিজ্যিক বিভিন্ন কোচিং সেন্টার আর সহায়ক বইয়ের বৈধতা দিয়েই চূড়ান্ত হচ্ছে শিক্ষা আইন, ২০২১। আইনে ভর্তি কোচিং বাণিজ্য, একাডেমিক কোচিং বাণিজ্যকে বৈধতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের পাঠ নয় বরং কোচিংয়ে উৎসাহিত করার আয়োজন চলছে। আর প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে নোট-গাইড নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও বৈধতা দেয়া হচ্ছে সহায়ক বই। অথচ শিক্ষাবিদরা বলছেন, নোট-গাইড আর সহায়ক বইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ আইন পাস হলে নিষিদ্ধ নোট-গাইডগুলো সহায়ক বই নামে চলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোচিং আর সহায়ক বই বৈধতা পেলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এটি হবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একেবারেই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন। শিক্ষা আইন নিয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল সভা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি বৈঠক করে প্রস্তাবিত এ আইন চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সভায়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এতে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড ঢাকা চেয়ারম্যানসহ অন্যরা এতে অংশ নেন। চূড়ান্ত করার আগে শিক্ষা আইনের খসড়া পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার জন্য মঙ্গলবার শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। কেউ এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এ ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নোট বই, গাইড বই ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘যা নোট-গাইড, সেটাই সহায়ক বই। নোট-গাইড আর সহায়ক বইয়ের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নাই। সহায়ক বই বৈধতা পেলে নোট-গাইডই সহায়ক বই নামে চলবে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
এ ছাড়া আইনে সরকারের অনুমোদন ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর পত্রিকায় মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্যিক কোচিংকে আইনে বৈধতা দেয়ার আয়োজন থাকলেও শিক্ষকদের জন্য নিজ শিক্ষার্থীদের কোচিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে এ আইনে। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে পাঠদান করতে পারবেন না। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুল সময়ের পূর্বে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ ছাড়া নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে অর্থের বিনিময়ে কোচিংয়ের মাধ্যমেও পাঠদান করতে পারবেন না। এটি অসদাচরণ ও শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এ আইনে নিষিদ্ধ হবে না। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোচিং পরিচালনা করতে পারবে না। করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠদান করতে পারবেন না। এটি অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া চাকরিপ্রার্থীদের জন্য কোচিং, বিভিন্ন ভর্তি কোচিং, বিদেশি শিক্ষাক্রমে ভর্তি উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনায় বৈধতা দেওয়া হয়েছে খসড়া আইনে।
আইনে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলোকে বৈধতা দিয়ে নিবন্ধন দেওয়ার আয়োজন রেখেছে সরকার। বলা হয়েছে, নিবন্ধন ছাড়া কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে না। নিবন্ধন ছাড়া কোচিং সেন্টার পরিচালনা করলে অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দ-ে দ-নীয় করা যাবে।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাণিজ্যিক এসব কোচিং সেন্টারের বৈধতা দেওয়া হবে কেন? এত দিন ধরে তো আমরা এসবের বিপক্ষেই বলে আসছি। কোচিং সেন্টার বৈধতা পেলে স্কুল-কলেজে পড়াশোনায় নয়, বরং কোচিংয়ে নির্ভরতা বাড়বে। কোচিং বৈধতা দেওয়া মানেই ক্লাসে পড়ানো কমে যাওয়া। এগুলো হবে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।’
শিক্ষাবিদদের এমন নেতিবাচক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ করা হয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বেশ কিছু কাজ এখনো বাকি রয়েছে। শিগগিরই আমরা আরেকটি বৈঠক করব। ওই বৈঠকের পর বলা যাবে কবে সেটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে।’ মন্ত্রী বলেন, শিক্ষা কারিকুলাম শিখননির্ভর করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসেই শিখবে। তখন আর নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আর তখন ছাত্র-ছাত্রীরা কোচিং সেন্টারেও যাবে না বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে আরও বলা হয়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর নিজ সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কার্যক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করা যাবে না। সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্ধারিত এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম বা প্রশাসনিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করলে ব্যবস্থাপনা কমিটি বা এর সভাপতি দায়ী থাকবেন। বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সনের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফি অযৌক্তিকভাবে উচ্চহারে আদায় করা হয়েছে এমন প্রতীয়মান হলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More