চট্টগ্রাম মেডিকেলে লাশের পোড়া গন্ধ : ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ অঙ্গার অর্ধশত

সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ : ৩০ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি

স্টাফ রিপোর্টার: স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কেশবপুরে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ডিপোর একটি শেডে কনটেইনারে আগুন ধরে রোববার পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। রোববার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ১৩ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন তিন শতাধিক, নিখোঁজ আছেন ৩৪ জন।

আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ শুরুর অন্তত আধঘণ্টা পর প্রচ- শব্দে কনটেইনারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কেঁপে ওঠে পুরো ডিপো ও ডিপোর বাইরের অন্তত ৫ কিলোমিটার এলাকা। কর্মরত শ্রমিক, ট্রাকচালক হেলপারসহ উপস্থিত অনেকে তুলার মতো উড়ে যায়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় অনেকের দেহ। কনটেইনারভর্তি বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ তথা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকেই আগুনের সত্রপাত। এ কারণেই বিস্ফোরণ এতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে ধারণা ফায়ার সার্ভিসের। দাহ্য পদার্থ থাকার তথ্য গোপন করায় উদ্ধারকর্মীদের অনেকে বিস্ফোরণে মারা গেছেন বলে অভিযোগ সংস্থাটির প্রধানের। আগুন লাগার পর প্রথমে স্থানীয় লোকজন, পরে ফায়ার সার্ভিস এবং পর্যায়ক্রমে পুলিশ ও সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। আইএসপিআর-এর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৫০ সদস্য উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। এছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সেনা বাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞদল কাজ করে। রাসায়নিক পদার্থ যাতে খাল বেয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তে না পারে, এ বিষয়ে তারা কাজ করছেন। রাসায়নিক পদার্থ যাতে পানিতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিবেশ দূষণ হবে না বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। এ ঘটনায় আলাদা ৬টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এদিকে শনিবার রাতে চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা গেলেও রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী রয়েছেন। অনেকের লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। নিখোঁজ অনেকের পরিবার হাসপাতল ও ডিপোর বিভিন্ন স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মৃতের স্বজনদের আজ সকালের মধ্যে হাসপাতাল আসতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয় আরও ৩ শতাধিক লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), পার্কভিউ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয় অনেকে। গুরুতর আহত ৫ ফায়ার ফাইটারসহ ১৪ জনকে ঢাকায় এনে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তাদের প্রত্যেকের অবস্থা আশঙ্কাজন। রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রেড ক্রিসেন্টের করা তালিকায় ৩৪ জন নিখোঁজের তথ্য পাওয়া যায়।

ভয়াবহ এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে। জাতীয় সংসদেও উত্থাপন করা হয় শোক প্রস্তাব।

ভয়াবহ অগ্নিকা- নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৩২টি ইউনিট, জেলা পুলিশ, সেনা বাহিনীর এক কোম্পানিরও বেশি সদস্য ডিপোর অগ্নিনির্বাপণ ও হতাহতদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। এছাড়া রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ব্লাডডোনেশন গ্রুপ, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশসহ স্বাস্থ্যসেবা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংগঠন হতাহত রোগীদের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার, হাসপাতালে ভর্তি, রক্ত প্রদান কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

একসঙ্গে এত অধিক রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। আহত রোগীদের চিকিৎসাসেবা যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য সিভিল সার্জন চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালের সব চিকিৎসকের ছুটি বাতিল ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পুলিশের ডিআইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল বিএম ডিপো পরিদর্শন করেন। অগ্নিকা-ের কারণ তদন্তে-ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপোর মালিক, সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ মোট ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলোকে রিপোর্ট প্রদানের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ডিপোর মালিকপক্ষ নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও আহতদের চিকিৎসাসেবা চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিহত পরিবারকে নগদ দুই লাখ ও আহতদের ৩০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফন-কাফনের জন্য ৫০ হাজার ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে: প্রত্যক্ষদর্শী ক্যাভার্ড ভ্যানের সহকারী মো. হাসান বলেন শনিবার সন্ধ্যায় ডিপোতে প্রবেশ করেন তিনি। তার সিরিয়াল পেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রাত সোয়া ১০টা কী সাড়ে ১০টার দিকে ডিপোর উত্তর পাশের শেডে রাখা একটি কনটেইনারে আগুনের সূত্রপাত হয়। ভেতর থেকে বের হতে থাকে ধোঁয়া। ডিপোর নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন কর্মচারী-কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে খবর পেয়ে সীতাকু- ফায়ার সার্ভিসকর্মীরাও এসে আগুন নেভাতে শুরু করেন। আগুন লাগার প্রায় পৌনে ১ ঘণ্টা পর হঠাৎ বিকট শব্দে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তারা প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করেন। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ডিপোর গেটের বাইরে চলে আসেন। তিনি আরও জানান, আগুন লাগার দৃশ্য অনেকে মোবাইলে ধারণ করছিলেন। তাদের অনেকে বিস্ফোরণে তুলার মতো উড়ে যান। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে এক কনটেইনার থেকে আরেক কনটেইনারে। পুরো এলাকায় ভীতিকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ঘটনার সময় অন্তত ২০০ ট্রাক ডিপোতে অবস্থান করছিল। ছিল ক্রেন এবং লরি। চালক-হেলপারসহ মালামাল লোড-আনলোড করার শ্রমিক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মচারী এবং ডিপো মিলে কয়েকশ লোক ছিলেন। যাদের বেশিরভাগই হতাহতের শিকার হয়েছেন।

হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকে আগুনের সূত্রপাত: হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কনটেইনারে লোড করার সময়ে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রোববার এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়কে এ তথ্য জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিএম কনটেইনার ডিপো ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। তবে এ ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর নিরাপদ ও অক্ষত রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। এছাড়া বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরেও দুটি কনটেইনার ভর্তি হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকার বিষয়টি জানিয়ে এগুলো দ্রুত বন্দর এলাকা থেকে সরাতে শুল্ক বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে এ ধরনের ১৮টি অফডক সচল রয়েছে। এসব অফডকে ৩৭টি পণ্য খালাস ও লোডের অনুমোদন দিয়েছে রাজস্ব বিভাগ। অফডকের অনুমোদন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও রাজস্ব বিভাগ দিয়ে থাকে। অফডকে কনটেইনার আসা-যাওয়া মনিটরিং করে রাজস্ব বিভাগ। অগ্নিকা-ের ঘটনায় রাজস্ব বিভাগ, অফডক কর্তৃপক্ষ ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় রাজস্ব বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করায় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় পৃথক কমিটি গঠন করেনি।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশে এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা এটাই প্রথম। সম্প্রতি লেবাননে বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনার পর সতর্কতার অংশ হিসাবে দেশের সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পদার্থ রয়েছে কিনা-সেই বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে বন্দরগুলোতে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই চিঠির প্রেক্ষিতে বিআইডব্লিউটিএ, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের বন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য বিপজ্জনক পদার্থ নেই বলে জানায়। এর কয়েক মাসের মধ্যে এ ঘটনা ঘটল।

চাপ সামলাতে হিমশিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ: একসঙ্গে এত অধিক রোগীর চাপ নিতে হিমশিম খেতে হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। শনিবার রাতে আগুন লাগার পর রাত ২টার দিকে চমেক হাসপাতালে ডিপো থেকে দগ্ধ রোগী আসতে থাকেন। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে কখনো লাশ, কখনো মুমূর্ষু রোগী নিয়ে আসা হয়। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, গাউসিয়া কমিটিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকজন হাসপাতালে রোগীদের গাড়ি থেকে নামানো, ওয়ার্ডে নেওয়া, ওষুধপত্র কিনে দেওয়াসহ নানা সেবা দেন। সকালের পরই রোগীতে ভর্তি হয়ে যায় হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ার ইউনিট, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং আইসিইউ শয্যা। এভাবে অন্তত ২০০ রোগী চমেক হাসপাতালে আসে। এর মধ্যে ৯৬ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কিছু রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিএমএইচে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বেসরকারি হাসপাতালে। বিকালে মুমূর্ষু ৫ ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ সাতজনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক ডা. রফিক উদ্দিন আহম্মদ বলেন, তার ওয়ার্ডে ভর্তি ৪৯ রোগীর সবার ৩ থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে এমন রোগীও এসেছে। অধিকাংশের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। তবে যেসব রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে এ ধরনের রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় । চাপ কমাতে এটি করা হয়।

চমেক হাসপাতালে রোগী নামানো রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মী ইশতিয়াকুল ইসলাম বলেন, এমন মৃতদেহ তারা দেখছেন কেবল মস্তক এসেছে। আবার কোনো কোনো মৃতদেহ এসেছে মুখম-ল থেতলানো। এক লাশের সঙ্গে আরেক লাশের জড়াজড়ি ও ল্যাপ্টানো অবস্থায়ও এসেছে। যেগুলো শনাক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। হাত-পা বিচ্ছিন্ন লাশ এবং রোগীও এসেছে।

লাশের সারি চমেক হাসপাতালে, পরিচয় মেলেনি অনেকের: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া অধিকাংশ লাশের পরিচয় নিশ্চিত বা লাশ শনাক্ত করতে পারেননি স্বজনরা। নিহতদের শরীরে থাকা জামা-কাপড় পুড়ে যাওয়ায় এবং চেহারা অগ্নিদগ্ধ হওয়ায় অনেক লাশের চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় লাশের পরিচয় শনাক্তে কাজ করছে পুলিশের সিআইডি এবং পিবিআইয়ের একাধিক টিম। রোববার সকাল থেকে দুই সংস্থার পুলিশ সদস্যরা নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে রোববার বিকাল ৪টা পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে ৪৩ জনের লাশ পৌঁছে। নিহতদের মধ্যে ১৫ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন-হাবিবুর রহমান (২৩), রবিউল আলম (১৯), মোমিনুল হক (২৪), মহিউদ্দিন (২২), তোফায়েল ইসলাম (২২), আফজাল হোসেন, মো. সুমন (২৮), মো. ইব্রাহিম (২৭), ফারুক জমাদ্দার (৫৫), হারুন-উর রশিদ (৫৫), মো. নয়ন (২২) এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মো. মনিরুজ্জামান (৫০), আলাউদ্দিন (৩৫), শাকিল তরফদার ও রানা মিয়া। চমেক হাসপাতালে লাশ শনাক্তের কাজে নিয়োজিত থাকা পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. মনির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘দুটি উপায়ে অগ্নিদগ্ধ হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। প্রথমে আমরা আঙুলের ছাপ সংগ্রহের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করছি। আগুনে যাদের আঙুল পুড়ে গেছে তাদের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।’

দুর্ঘটনা তদন্তে ছয় কমিটি: বিএম ডিপোর অগ্নিদুর্ঘটনা তদন্তে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা মালিক পক্ষের, নাশকতা কিনা খতিয়ে দেখার অনুরোধ: বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, মর্মান্তিক এ ঘটনায় হতাহতদের জন্য সমবেদনা জানানোর ভাষা জানা নেই। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব তারা নেবেন। আহতদের চিকিৎসার সর্বাত্মক খরচ বহন করবে কোম্পানি। এ ঘটনা কেন ঘটেছে তা তদন্ত করার জন্য তারা ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি সরকারি কমিটিগুলোকেও সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তবে এই ঘটনা সে ফ দুর্ঘটনা, নাকি কোনো নাশকতা বা প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধনের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান। ডিপোর ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) নাজমুল আক্তার বলে, ২৬ একর জমিতে গড়ে তোলা এই ডিপোর ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টিইইউএস। ডিপোতে শনিবার ৪ হাজার ৩০০ টিইইউএস কনটেইনার ছিল। দুর্ঘটনার সময় ডিপোতে দুই শিফটের দুই শতাধিক কর্মী ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

সরেজমিন ডিপোর ভেতরের দৃশ্য: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপাশে সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম ডিপোর অবস্থান। রোববার সকালে গিয়ে মহাসড়কের এক কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কু-লী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। ডিপোটির ভেতরে প্রবেশের পরই রয়েছে খাবারের ক্যান্টিন। এরপর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অফিস। পুরো ডিপোটি হেঁটে ঘুরে আসতে প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ডিপো ঘুরে দেখা গেছে, ডিপোটির প্রধান অফিস পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। অফিসের দেওয়াল বিধ্বস্ত, শেডের চালার লোহার পাতগুলো তুলার মতো উড়ে গেছে। নীল রংয়ের ড্রামগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরো ডিপোর মাঠে। একেকটি বড় বড় কনটেইনার পুড়ে হয়ে গেছে ছাইভস্ম। ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণ, রাসায়নিক পদার্থ যাতে খাল বেয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তে না পারে সেই তৎপরতা চালান। বিস্ফোরণের ভয়ে উদ্ধারকর্মী বা অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা জ্বলন্ত কনটেইনারের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস করছিলেন না। তাই আগুন লাগার দীর্ঘ প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর গতকাল বিকাল তিনটায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

ডিপো মনিটরিংয়ে অবহেলা থাকার সন্দেহ নৌ প্রতিমন্ত্রীর: বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনার পেছনে মনিটরিং টিমের অবহেলা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বলা যাবে দায়ী করা। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। রোববার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

আহতদের দেখতে এলেন যারা: চমেক হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরানো ব্যক্তিদের দেখতে এসেছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এমএ সালাম, নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন, সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, রাত থেকেই রোগীদের হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেন রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল।

বিএম ডিপোর ঘোষণা-নিহত প্রত্যেকের পরিবার পাবে ১০ লাখ টাকা : সীতাকু-ের ভয়াবহ অগ্নি বিস্ফোরণে মৃত প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ টাকা সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ। এছাড়া দুর্ঘটনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রোববার সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া যারা গুরুতর আহত হয়েছেন কিংবা অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন, তাদেরকে ৬ লাখ টাকা করে এবং আহতদের ৪ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে।

বিএম কনটেইনার মালিক পক্ষ জানান, এই মর্মান্তিক অগ্নিদুর্ঘটনায় মারা যাওয়া প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারীর পরিবারে শিশু থাকলে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার পরিবারকে বেতনের সমপরিমাণ টাকা কর্তৃপক্ষ প্রদান করবে। এছাড়া উপার্জনক্ষম সদস্য থাকলে চাকরির ব্যবস্থা করার প্রতিশশ্রুত দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More