চারশ’ মানুষকে লিবিয়ায় পাচার করেছে হাজি কামাল

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যা : পাচারকারী চক্রের মূলহোতা আটক
স্টাফ রিপোর্টার: গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে নৃশংস হত্যাকা-ে ২৬ বাংলাদেশি নিহত এবং ১১ বাংলাদেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত পাচারকারী চক্রের মূলহোতা হাজি কামালকে রাজধানীর গুলশান শাহজাদপুর এলাকা থেকে আটক করে র‌্যাব। হাজি কামাল গত ১০ বছর ধরে অন্তত চারশত লোককে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠিয়েছেন। লিবিয়ার মিজদাহ শহরে নিহত ও আহতদের বেশিরভাগ লোককেই হাজি কামাল পাঠিয়েছেন। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর পাচারকারী চক্র পরিবারের কাছ থেকে যে মুক্তিপণ আদায় করেছে, তার সব টাকাই হাজি কামালের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে। এদের মধ্যে লালচান ও তরিকুল ইসলামের মুক্তিপণ নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন হাজি কামাল। লালচান নিহত হয়েছেন এবং তরিকুল মারাত্মক আহত হয়ে মিজদাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল সোমবার দুপুরে র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান এসব তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘লিবিয়ায় হত্যাকা-ের পর নিহত ও আহতদের পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী সবাই হাজি কামালকে মুক্তিপণের টাকা দিয়েছে। এরপরও কেউ সন্তানদের ফেরত পাননি। হাজি কামালকে গ্রেফতারের সময় পাওয়া ডায়রিতেও টাকা নেয়ার তথ্য রয়েছে। কামাল নিজেও স্বীকার করেছেন টাকা নেয়ার কথা। আর কামাল এসব টাকার একটি অংশ বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতেন।’
র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান আরো বলেন, ‘কামালের কাছে পাওয়া ডায়রিতে অন্তত চারশত ভিকটিম ও তার পরিবারের মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। এদের কাছ থেকে কামাল টাকা আদায় করেছেন। ওই ডায়রিতে ১০ জন দালালের তথ্য রয়েছে, যারা কামালের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এই দালালরা ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মাগুরা ও গোপালগঞ্জ এলাকা থেকে মানুষ সংগ্রহ করে। এরা কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিশর ও লিবিয়াতে পাচারের কাজ করে থাকে।’
লে. কর্নেল রকিবুল হাসান বলেন, ‘হাজি কামালের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তিনি গত ১৫ বছর ধরে ঢাকায় বাস করছেন। এর মধ্যে ১০ বছর ধরেই মানবপাচারের কাজ করে আসছেন কামাল। তার কাছ থেকে বিভিন্ন মানুষের ৩১ টি পাসপোর্ট ও একাধিক ব্যাংকের চেকবই উদ্ধার করা হয়েছে। তার সম্পদের খোঁজ করা হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে কোথায় কোথায় টাকা গেছে, তা জানার পর মানি লন্ডারিং আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।’
র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান বলেন, ‘হাজি কামালের কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নেই। তিনি মূলত টাইলস ঠিকাদার। এর আড়ালেই মানবপাচার করতেন তিনি। লিবিয়া হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে যাওয়াদের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ লোকই কামালের মাধ্যমে গেছেন। এই চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। বিদেশে গমনের জন্য পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয় ইত্যাদি কার্যাবলী এই সিন্ডিকেটের তত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তাদেরকে এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে। ইউরোপ গমনের ক্ষেত্রে তারা ৭-৮ লাখ টাকার বেশি অর্থ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় গমনের পূর্বে এবং বাকি আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লিবিয়ায় গমনের পর ভিকটিমের স্বজনের কাছ থেকে নিয়ে থাকে। কামালকে মাদারীপুর রাজৈর থানা ও কিশোরগঞ্জের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।’
বাংলাদেশ হতে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করে থাকে। সেই রুটগুলো তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী মাঝে মধ্যে পরিবর্তন অথবা নতুন রুট নির্ধারণ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়াতে পাঠানোর ক্ষেত্রে যে রুটটি ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানায়, তা হলো,বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিশর-বেনগাজী-ত্রিপলী (লিবিয়া)। দুবাইয়ে পৌঁছে তারা বিদেশি এজেন্টদের তত্বাবধানে ৭-৮ দিন অবস্থান করে। বেনগাজীতে পাঠানোর জন্য বেনগাজী থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামক একটি ডকুমেন্ট দুবাইতে প্রেরণ করে। যা দুবাইয়ে অবস্থানরত বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এরপর সেই ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্ট তাদেরকে মিশর ট্রানজিট নিয়ে বেনগাজী পাঠায়। বেনগাজীতে বাংলাদেশি এজেন্ট তাদেরকে বেনগাজী থেকে ত্রিপলিতে স্থানান্তর করে।
ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর ত্রিপলিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তারা ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। এরপর ত্রিপলিতে অবস্থানকালীন সময়ে বর্ণিত এজেন্টদের দেশীয় প্রতিনিধির দ্বারা ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন হতে অর্থ আদায় করে থাকে। এরপর ভিকটিমদের ত্রিপলির বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের নিকট অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে হস্তান্তর করে। এরপর উক্ত সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিক নির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর রাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেলের হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরের মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং জীবনাবসানের ঘটনা ঘটে থাকে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More