জোগানে ভাটা : ফের সয়াবিন আটা চিনির দাম বাড়ালো সরকার

নিত্যপণ্যের বাজারে নেই শুভবার্তা : দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ আরও দুর্বিপাকে

স্টাফ রিপোর্টার: নিত্যপণ্যের বাজারে নতুন কোনো শুভবার্তা নেই, আছে দুঃসংবাদ। ভোজ্যতেল আর চিনির দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনি ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। গরিবের ওএমএসের আটাতেও পড়েছে দামের থাবা। ৬ টাকা বেড়ে এখন এক কেজি আটা কিনতে খেটে খাওয়া মানুষকে গুনতে হবে ২৪ টাকা। এর আগে গত রোববার বাজারের আটার দামও কেজিতে বেড়েছিল ৬ থেকে ৭টাকা। ফলে নিত্যপণ্যের দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষ আরও দুর্বিপাকে পড়ল। এদিকে কয়েক দফা দাম বাড়ানোর পরও বাজারে ভোজ্যতেল, চিনি ও আটার সংকট এখনও কাটেনি। কোনো কোম্পানি চিনি দিচ্ছে তো ভোজ্যতেল দিচ্ছে না। কেউ তেল দিলেও আটা সরবরাহ করছে না। এ কারণে বাজারে প্রয়োজনীয় এ তিন পণ্যের কিছুটা টান পড়েছে। তবে পাড়া-মহল্লায় এ সংকট খানিকটা বেশি। আবার কিছু জায়গায় এসব পণ্য পাওয়া গেলেও ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, চিনির সংকট চলছে প্রায় দেড় মাস। এরপর যুক্ত হয়েছে আটার ঘাটতি। এক সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে লুকোচুরি। কোম্পানিগুলোর ডিলাররা চাহিদাপত্র নিয়েও পণ্য দিতে করছেন গড়িমসি। কোনো কোনো ডিলার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করায় দিচ্ছেন না ক্রয় রসিদ। এ কারণে খুচরা পর্যায়েও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকার গতকাল ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এখন কোম্পানিগুলো হয়তো বাজারে এ দুই পণ্যের সরবরাহ বাড়াবে। আর কোম্পানিগুলো বলছে-রাতারাতি এত গ্যাস গেল কই? এলএনজি আমদানি হচ্ছে না। এ কারণে গ্যাসের সংকট। ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ মাত্র এক বছরে ৩৪ বিলিয়নে নেমেছে। ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও ভালো নয়। রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এসবই অর্থনীতিকে ফেলেছে চাপে। অর্থনীতি মূলত বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে বেসরকারি খাত ধুঁকছে ডলার, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে। আমদানি থিতু হওয়ার কারণে উৎপাদন কমেছে। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের বাজারে।

জানা গেছে, গত তিন-চার মাসে আটার দাম বেড়েছে পাঁচ দফা। আগস্টের শুরুতে প্যাকেটজাত আটার কেজি ছিল ৫১ থেকে ৫২ টাকা; এরপর ওই মাসের মাঝামাঝিতে হয় ৫৭ থেকে ৫৮ টাকা। অক্টোবরে এসে দাঁড়ায় ৬২ থেকে ৬৩ টাকা। নভেম্বরের শুরুতে আটার কেজি ছিল ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা। পাঁচ দিন আগে দাম আরেক দফা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭১ টাকায়। তবে প্যাকেটজাত আটার চেয়ে তিন থেকে পাঁচ টাকা কমে মিলছে খোলা আটা। গত দুই মাসে তিন দফা বাড়িয়ে খোলা চিনির কেজি ৯০ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ নির্ধারণ করে সরকার। এরপরও সংকট তৈরি হয় পণ্যটির। এখন সরকার আরেক দফা দাম বাড়িয়ে কেজি ১০৮ টাকা করেছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা গত ১ নভেম্বর সয়াবিন তেলের লিটারে ১৫ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়ার কয়েকদিন পর থেকেই তেলের সংকট শুরু হয়। কিছু জায়গায় খোলা সয়াবিন মিলছে, তবে লিটারে গুনতে হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা। বোতলজাত তেলের সরবরাহ খুব কম দেখা গেছে। তবে গতকাল তেলের নতুন দাম নির্ধারণ হওয়ায় সরবরাহ আবার বাড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি মাসের ১ তারিখ লিটারপ্রতি ১৫ টাকা দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম মোল্লা। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অস্বাভাবিক দরপতনের ফলে সংগঠনভুক্ত সদস্যরা বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৩ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এর পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করে ট্যারিফ কমিশন মূল্য পর্যালোচনা করে। পরে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিবের সম্মতিতে নতুন দর কার্যকর করা হয়। এদিন ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তেল ও চিনির নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। আমাদের মৌখিকভাবে বিষয়টি মন্ত্রণালয় সম্মতি দিয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকেই এ দাম কার্যকর হয়েছে। জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বিশ্বজুড়ে পণ্যের দামে টালমাটাল অবস্থায় আছে। মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব দেশেও পড়ছে। তবে কেউ দাম নিয়ে অসাধুতা বা কারসাজি করতে না পারে সেদিকে তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঠিক ততবার আমরা বাজারে কঠোর মনিটরিং করেছি। যাতে নির্ধারিত দামের চেয়ে কেউ বেশি আদায় করতে না পারে। যে দামে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই দামেই বিক্রি করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ঠিক করে, আর সেটি সরকার কার্যকর করে। কয়েক দফা ভোজ্যতেলের মূল্য কমানো ও বাড়ানো হয়। এটি একটি ‘আই ওয়াশ’। কারণ যতবার দাম কমানো বা বাড়ানো হয় বাজারে এটি কার্যকর হতে দেখা যায় না। বরং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশিতে বিক্রি হয়েছে। যা কাম্য নয়। তিনি আরও বলেন, বাজার তদারকি সংস্থাগুলো যে কোনো কাজ করেনি তাও বলা যাবে না। তারা যথেষ্ট কাজ করেছে। অভিযান পরিচালনা করেছে। মূল্য কারসাজিতে প্রতিযোগিতা কমিশন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিজ আইনে মামলা করেছে। এর সঙ্গে বাজার তদারকি আরও কঠোরভাবে করা দরকার।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More