ট্রেনের টিকিট কাটতে রাত জেগে যুদ্ধ : কেউ হাসছেন কেউ কাঁদছেন

ঈদযাত্রায় মাত্র ১৩ হাজার ৩৩৬টি টিকিটের বিপরীতে প্রত্যাশী ছিলেন লক্ষাধিক

স্টাফ রিপোর্টার: যারা প্রতিটি মুহূর্ত ‘যুদ্ধ’ করে, তারা বোধহয় পালাতে জানেন না। দীর্ঘ সময় ধরে লড়তে লড়তে মনে হয় লড়ে যাওয়াটাই তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। শনিবার এমনটি মনে হয়েছে ঈদযাত্রায় ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটার দৃশ্য দেখে। বিশেষ করে নারীদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। কমলাপুরসহ রাজধানীর আরও চারটি রেলওয়ে স্টেশনে কয়েকশ নারীর রাত জাগাও ছিলো চ্যালেঞ্জের। মাত্র ১৩ হাজার ৩৩৬টি টিকিটের বিপরীতে প্রত্যাশী ছিলেন লক্ষাধিক। যারা ২৭ এপ্রিলের টিকিট পেয়েছেন, আনন্দের শেষ ছিলো না তাদের। যারা টিকিট পাননি-দুঃখ ছিল তাদের। কিন্তু, লড়াইয়ে হেরে যাননি অনেকেই। ফের লাইনে দাঁড়িয়েছেন ২৮ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট কাটার জন্য।

পাঁচ দিনব্যাপী অগ্রিম টিকিট বিক্রির প্রথম দিন ছিলো শনিবার। ২৬ হাজার ৬৭২টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেক বিক্রি হয় অনলাইনে, বাকি অর্ধেক কাউন্টারে। এদিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলগামী আন্তঃনগর এবং খুলনাগামী স্পেশাল ট্রেনের ২৭ এপ্রিলের জন্য টিকিট বিক্রি হয়। ১৩,৩৩৬টি টিকিটকে ৫ ভাগে ভাগ করলে একেকটি স্টেশনে মাত্র ২ হাজার ৬৬৭টি টিকিট বিক্রি হওয়ার কথা। এমন অবস্থায় শনিবার শুধু কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিলেন। এরসঙ্গে প্রতিদিনের লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের যাত্রীতো ছিলেনই। সব মিলিয়ে স্টেশন ঘিরে প্রায় ৩০ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়বে-এমন আভাস সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল এবং ১ মে স্টেশনে মানুষের ঢল নামবে। কিন্তু, টিকিট বাড়বে না। সীমিত টিকিট পেতে, দীর্ঘ লড়ায়ের যুদ্ধটাও বাড়বে।

শনিবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম পরিদর্শন করেন রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বিশেষ টিম’। টিম প্রধান রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী জানান, ৫টি স্টেশনে একযোগে টিকিট দেয়া হচ্ছে সীমিত সংখ্যক ট্রেনের নির্ধারিত টিকিট। যাত্রীদের জন্যই আমরা কাজ করি। ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত প্রায় শতাধিক কোচ (বগি) চলমান ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত করেছি। অতিরিক্ত যাত্রীবহনে আমাদের চেষ্টার শেষ নেই। কোনো টিকিট ব্লক রাখা হয়নি, রাখার কোনো ব্যবস্থাও নেই। যারা টিকিট পাচ্ছেন না, তারা স্বাভাবিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে নানা কথা বলছেন, বিষয়টা আমরা বুঝি। কমলাপুর স্টেশনে যে সংখ্যক টিকিট বিক্রি হয়, তার বহুগুণ বেশি যাত্রী অবস্থান করেন। কাউন্টার থেকে সব টিকিট বিক্রি হচ্ছে।

শনিবার সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ২৩টি কাউন্টার রয়েছে। তিনটি কাউন্টার থেকে নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের টিকিট প্রদান করা হচ্ছে। একই সঙ্গে রাজধানীর বিমানবন্দর, তেঁজগাও, ফুলবাড়িয়া, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অগ্রিম টিকিট বিক্রি হচ্ছে। কমলাপুর স্টেশন কাউন্টারে সেহরি খেয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন জিন্নাত আরা মুন্নি নামের এক নারী। জানালেন, রাজধানীর রাজারবাগ এলাকায় থাকেন। ভোররাতে শত ভয় উপেক্ষা করেই স্টেশনে পৌঁছেন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের ২টি শোভন চেয়ার টিকিট কাটতে পেরেছেন। এসি চেয়ার চেয়েছিলেন, পাননি। তার হাতে টিকিট দুটি আসার মুহূর্তেই মাইকে ঘোষণা আসে, সিল্কসিটি এক্সপ্রেসসহ পশ্চিমাঞ্চলে চলা প্রায় সবকটি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি শেষ। এ সময় আনন্দে তিনি কাঁদতে থাকেন।

টিকিট পেয়ে মুন্নী হেসেছেন, আবার বহু নারী ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট না পেয়ে কষ্ট পেয়েছেন। যাত্রাবাড়ী থেকে আসা রহিমা খাতুন জানালেন, তিনি পরিচয়পত্র আনেননি। প্রায় ৫ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে পৌঁছানোর পর তিনি জানতে পারেন এনআইডির ফটোকপি লাগবে। একপর্যায়ে তিনি টিকিট না নিয়েই স্টেশন থেকে চলে যান। এক নারী বুকিং সহকারী জানান, পরিচয়পত্রের ফটোকপি রেখেও টিকিট দেয়া হচ্ছে। ফটোকপি দেখে কোনো যাত্রীকেই চিহ্নিত করা যায় না। গ্লাসের মধ্যে ছোট্ট একটা ছিদ্র রয়েছে, আমরা শুধু যাত্রীদের কথা শুনতে পারি, চেহারা দেখতে পাই না।

শনিবার ৩৬ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি হয়। আজও সমসংখ্যক ট্রেনের ১৩ হাজার ৩৩৬টি টিকিট বিক্রি হবে। সোমবার আরও দুটি স্পেশাল ট্রেন যুক্ত হচ্ছে, সেই দুটি স্পেশাল ট্রেনে প্রায় ১৭শ টিকিট যুক্ত হবে। এ ১৭শ টিকিট শুধু কাউন্টার থেকে বিক্রি হবে। স্পেশাল ট্রেনের কোনো টিকিট অনলাইনে বিক্রি হবে না। অর্থাৎ ২৯, ৩০ এপ্রিল ও ১ মে তিন দিন কাউন্টারে টিকিট বিক্রি হবে, ১৫ হাজার ৩৬টি। এ দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হবে। এদিকে শনিবারও সার্ভার নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ ছিলো। সার্ভার ত্রুটির কারণে যাত্রী দুর্ভোগ আরও চরমে উঠে।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরোয়ার জানান, ২৯ এপ্রিল থেকে তিন দিন পর্যন্ত সারা দেশে ৬ জোড়া স্পেশাল ট্রেনের টিকিটও বিক্রি হবে। সীমিত টিকিটের বিপরীতে হাজার হাজার মানুষ স্টেশনে আসছেন। কেউ টিকিট পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। আমরা শতভাগ টিকিট কাউন্টার থেকে বিক্রি করছি। কোনো হেরফের হচ্ছে না। কমলাপুরে সবচেয়ে বেশি ভিড় হচ্ছে। বাকি ৪টি স্টেশনেও সোমবার থেকে প্রচ- ভিড় হবে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন জানান, সার্ভার ত্রুটির বিষয় আমরা মেনে নিচ্ছি না। প্রতিষ্ঠানটি নতুন এসেছে। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক করেছি। কাউকেই আমরা ছাড় দেব না। তিনি বলেন, এবার যাত্রীদের চাপ বেশি। যাত্রীদেরও সহযোগিতা চান তিনি।

ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শফিকুল ইসলাম জানান, কমলাপুরসহ বাকি ৪টি স্টেশনে একযোগে টিকিট বিক্রি হচ্ছে। টিকিট সীমিত, যাত্রীদের চাপ অতিরিক্ত। আমরা কাউন্টার থেকে যথাযথ নিয়মে টিকিট বিক্রি করছি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More