দুর্বল নীতিমালায় চলছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান

স্টাফ রিপোর্টার: দুর্নীতি ও প্রতারণার অপরাধে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনার কর্তৃত্ব নেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আছে শুধু একটি নীতিমালা ও নির্দেশিকা। অপরাধের দায়ে সেখানে নেই কোনো শাস্তির বিধান। এমনকি এখন পর্যন্ত হয়নি এসব ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় পৃথক আইন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১১টি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া আরও এক হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অব্যাহত রেখেছে যাবতীয় কার্যক্রম। এর আগে ই-কমার্সের আদলে যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটু নামক প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেসি) থেকে নিবন্ধিত।
এদিকে ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণ আনতে একটি স্বাধীন ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চেয়ে সোমাবার রিট হয়েছে আদালতে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম রিট করেছেন। ই-কমার্স বাণিজ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত ও গ্রাহকের অধিকারবিরোধী চর্চা রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা বা ব্যর্থতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে রিটে। বাণিজ্য সচিব, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সচিব, অর্থসচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্টসহ ছয়জনকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান বলেন, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক কোনো আইন নেই। বাংলাদেশেও নেই। কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন পৃথক আইনের। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সেখানে ৩.৫ এর(৩) ধারায় বলা আছে, ‘ডিজিটাল কমার্স সংশ্লিষ্ট অপরাধ চিহ্নিত হলে তা দেশে প্রচলিত সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ নীতিমালার ৩.৬ এর(১) ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা, বিক্রয়কৃত পণ্য সরবরাহ ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণ তদারকি এবং এর সব কর্মকা- হতে উদ্ভূত অসন্তোষ নিরসন ও অপরাধগুলোর বিচার ডিজিটাল নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
এই নীতিমালার আলোকে করোনাকালীন দেশে ই-কমার্স বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বর্তমানে সারা দেশে ১ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন রয়েছে। তবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, ১ হাজার ৬০৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে। শুধু নীতিমালা এবং আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়েছে। কিন্তু এসব টাকা ফেরত দিচ্ছে না। বহুল আলোচিত ইভ্যালিও নিয়েছে গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা ফেরত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ধামাকার ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ১৫০ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপের ১১০ কোটি টাকা। এছাড়া নিরাপদডটকম ৮ কোটি, চলন্তিকার ৩১ কোটি, সুপম প্রোডাক্ট ৫০ কোটি, রূপসা মাল্টিপারপাস ২০ কোটি, নিউ নাভানা ৩০ কোটি এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিং গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের টাকা ফেরত আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে না পারলেও প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধন নিয়েই পরিচালিত হয়ে আসছে।
জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানসহ সিআইডি মোট ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে। বেশির ভাগের বিরুদ্ধে গ্রাহককে পণ্য না দেয়া, টাকা ফেরত না দেয়া, চেক দিলেও ব্যাংকে টাকা না থাকা এবং সরবরাহকারীদের টাকা না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ই-কমার্সের আদলে ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া যুবক, ডেসটিনি ও ইউনিপেটু-এর মতো প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের টাকা ফেরত আনার বিষয়ে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুবকের সারা দেশে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ পড়ে আছে। এ প্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ গ্রাহকদের পাওনা ২৬শ কোটি টাকা। সম্পত্তি বিক্রির অর্থ দিয়ে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন এ প্রতিষ্ঠানে একজন প্রশাসক বসানো। এজন্য একজন প্রশাসক নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটিও প্রশাসক বসিয়ে টাকা ফেরত আনার সুপারিশ করেছে। এরই মধ্যে কেটে গেছে দেড় বছর। এরপরও একজন প্রশাসক আজও পর্যন্ত বসাতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুবকের গ্রাহকদের সংগঠন ‘যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত জনকল্যাণ সোসাইটির’ সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মুকুল যুগান্তরকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও যুবকের প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করেছে। এরপরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
জানা যায়, ২০০৬ সালে যুবক গ্রাহকের কাছ থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপেটুইউ ৬ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ডেসটিনি ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বড় ধরনের কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More