দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর তৎপরতা

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে থাকায় লোকসান কমাতে দেশের বাজারেও তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বাংলাদেশের চাইতে বেশিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল কিংবা ফার্নেস অয়েল। তুলনামূলক কম দাম হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে তেল পাচারের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এই অজুহাতেই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসি বলছে, সরকার নির্ধারিত আগের দরে ডিজেল বিক্রি করতে গিয়ে এখন তাদের প্রতি লিটারে ১৩ থেকে ১৪ টাকা লোকসান হচ্ছে। প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম ‘অ্যাডজাস্ট করতে হবে’ মন্তব্য করে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিশাল লস হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে তেলের দাম বেড়ে গেছে। কয়েক গুণ বেড়েছে। খুব খারাপ অবস্থা। ডিজেলের লোকসানই বেশি ভাবাচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডিজেলটাই আমাদের জন্য বেশি ক্ষতিকারক। বিশ্ববাজারে দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পুনঃনির্ধারণের পক্ষে আরও একটি যুক্তি দেখিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারত দুইবার তেলের দাম বাড়িয়েছে। আমাদের সঙ্গে তারতম্য থাকলে বর্ডার এলাকা থেকে তেল চোরাচালান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মহামারির ধকল সামলে বিশ্ব অর্থনীতি গতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেলের বাজারও চড়ছে কিছুদিন ধরে। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৮৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে-যা সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এ বিষয়ে বিপিসি’র পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। দেশে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। তাতে লিটার প্রতি ১৩ থেকে ১৪ টাকা লোকসান হচ্ছে। তিনি বলেন, বিষয়টি সমপ্রতি তারা মৌখিকভাবে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন। এতে প্রতিদিন ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিপণনে ২০ কোটি টাকার মতো লোকসান হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন। সরকার এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে তেলের দাম বাড়ছে। তেলের দাম আরও বাড়লে এই লোকসানটাও বাড়বে। সরকার আগেও তেলে ভর্তুকি দিয়েছে। মাস তিনেক আগে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম যখন ৭০ ডলার ছাড়ালো তখন থেকেই তাদের লোকসান শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে বিপিসি’র বিপণন লোকসানের মুখে পড়েছে।
বিপিসি’র তথ্য অনুযায়ী, চাহিদা পূরণে প্রতিবছর ৪০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। আর অকটেন আমদানি করা হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন। প্রায় সমান পরিমাণ পেট্রোল উৎপাদন করা হয় দেশীয় উৎস থেকে। আগে পেট্রোল ও অকটেন বিপণনে বিপিসি’র মুনাফা থাকলেও এখন তার বদলে লোকসান হচ্ছে বলে কর্মকর্তাদের ভাষ্য। সরকার সর্বশেষ ২০১৬ সালে যখন প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা ঠিক করে দিয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৪০ থেকে ৫০ ডলারের আশেপাশে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়, তার ৭৩ শতাংশের বেশি ডিজেল। সড়ক ও নৌ পরিবহন, কৃষির সেচ পাম্প এবং বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ক্ষেত্রে ডিজেলের ব্যবহার রয়েছে। বিপিসি’র হিসাবে ২০১৯-২০২০ বছরে বিপিসি ৫৫ লাখ ৩ হাজার টন জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে। এরমধ্যে ডিজেলের পরিমাণ ৪০ লাখ ২৩ হাজার টন।
গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সাধারণত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল ও মেরিন ফুয়েলের মতো অন্য তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিপিসি’র কাছে অর্পণের দাবি জানায় সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে আনতে হয় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন এসব জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ছে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, দুই বছর বা তারচেয়ে বেশি সময় ধরে তেল বিক্রি করে সরকার লাভ করেছে সেই টাকা কোথায় গেল? যখন বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কম ছিল তখন দেশে বেশি দামে তেল বিক্রি করেছে। এখন লুণ্ঠনমূলক দাম বৃদ্ধি করে অসাধু ব্যবসা করতে চায়। করোনাকালে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। এমনিতেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় তেলের দাম বাড়লে ভয়ঙ্কর অবস্থার আশঙ্কা করছেন এই বিশেষজ্ঞ। বরং এই মুহূর্তে সরকারকে জনগণের পাশে থেকে সুরক্ষা দেয়া দরকার বলে ড. শামসুল আলম মনে করেন। কিন্তু তা না করে সরকারকে অপ্রিয় করে তুলছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More