এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ ও ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সোমবার কক্সবাজারে একটি হোটেলে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা এখন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি। এক বছর আগে আমরা এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরতে কক্সবাজারে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সংলাপ ‘স্টেকহোল্ডার্স’ ডায়ালগ : টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাইলেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শুরু হয়েছে সোমবার। উদ্বোধনী বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য সাত দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতি থামাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সাত দফা প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে-রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন, দাতাদের অব্যাহত সমর্থন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা, গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুপুর সোয়া ১টার দিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার ছাড়েন। এর আগে সকাল ১০টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছেন। এ সময় কক্সবাজার বিমানবন্দরে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজারের ইনানী বে-ওয়াচ হোটেলে ৪০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দেন তিনি।
সংলাপে অংশগ্রহণ করছেন কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ, বৈশ্বিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। এ সংলাপ থেকে আসা প্রস্তাব এবং বক্তব্যগুলো ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে তুলে ধরা হবে। নিউইয়র্কের ওই সম্মেলনে প্রায় ১৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাসহ নিপীড়নের শিকার মিয়ানমারের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর দুর্দশা গুরত্ব সহকারে আলোচনা হবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জরুরি বলে মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগে বক্তব্য রাখতে পেরে আমি আনন্দিত। আপনাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, আজ অষ্টম ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবসে’ আমি গভীর শোকের সঙ্গে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও মিয়ানমার থেকে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের দিকে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০১৭ সালের আগস্টে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজও তাদের ওপর অমানবিক আক্রমণ ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। তাই আজও নতুন নতুন রোহিঙ্গা আমাদের সীমান্তে প্রবেশ করছে।
তিনি বলেন, আমরা আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত চোখ দেখি সেই নারী-পুরুষদের, যারা ভয়ংকর নির্যাতনের গল্প নিয়ে সীমান্তে উপস্থিত হয়। এসব গল্পের মধ্যে রয়েছে পরিকল্পিত নিপীড়ন, নাগরিকত্ব অস্বীকার, জোরপূর্বক বিতাড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অমানবিক নির্যাতন, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া। তাই বাংলাদেশ ২০১৭ সালে এবং তারও আগে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল, যাতে তাদের জীবন রক্ষা পায়। যদিও আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল। এটি আমাদের মানবিক সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
তিনি বলেন, আমরা আর নীরব থাকতে পারি না। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই যেন তারা যৌথভাবে মিয়ানমার জান্তা ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা চালানো থেকে বিরত রাখে। আজ বিশ্বসম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জরুরি।
ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য দাতা দেশ, আমাদের অংশীদার, জাতিসংঘ সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বিশ্বের বন্ধুদের অব্যাহত সহায়তা ও সংহতির জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। রোহিঙ্গারা যতদিন না স্বদেশে ফিরে যাচ্ছে, ততদিন আপনাদের সহায়তা অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ থাকবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে, যা কক্সবাজারকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত করেছে। প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নবজাতক জন্ম নিচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে।
অন্যদিকে মিয়ানমারে বর্তমানে মাত্র পাঁচ লাখেরও কম রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এটি প্রমাণ করে, নির্যাতন অব্যাহত থাকায় রোহিঙ্গারা এখনো মিয়ানমার ছাড়ছে।
ড. ইউনূস বলেন, গত আট বছরে বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয়রা, বিরাট ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমাদের অর্থনীতি, সম্পদ, পরিবেশ, সমাজ ও শাসনব্যবস্থার ওপর এর বিরাট প্রভাব পড়েছে। আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের জনগণকে এই বিপুল ত্যাগ ও সহায়তার জন্য। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে আর কোনো সহায়তা মজুত করার সুযোগ আমরা দেখছি না।
প্রধান উপদেষ্টার ৭ প্রস্তাব : রোহিঙ্গা সংকট ও এর টেকসই সমাধান সমাধানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন-প্রথমত, রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন করা। এজন্য রোডম্যাপ প্রণয়ন জরুরি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দাতা দেশ ও মানবিক অংশীদারদের নিরবচ্ছিন্ন অবদান অপরিহার্য। আমরা দাতাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধির আহ্বান জানাচ্ছি। টেকসই অর্থায়নে যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, জীবিকা ও স্বস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। চতুর্থ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিগত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আস্থা বাড়াতে, উত্তেজনা কমাতে এবং সংঘাত নিরসনে একটি সংলাপ প্ল্যাটফর্ম জরুরি। পঞ্চম, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা, বিশেষ করে আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আসিয়ান ‘৫ দফা ঐকমত্য’-সহ আন্তর্জাতিক সব উদ্যোগকে সমর্থন করি। ষষ্ঠ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের অবশ্যই জাতিগত নিধনের মতো নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই যেন তারা মিয়ানমার, আরাকান আর্মি ও সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃসমন্বয় করেন, যাতে এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের দ্রুত সমাধান সম্ভব হয়। সপ্তম, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে চলমান আন্তর্জাতিক জবাবদিহি প্রক্রিয়াগুলোকে আরও গতিশীল করতে।
নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবি রোহিঙ্গাদের : এদিকে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সোমবার পালিত হয় তাদের অনিশ্চত যাত্রার ৮ বছর। দিনটিকে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস’ হিসাবে পালিত হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচটি পৃথক জায়গায় লাখো রোহিঙ্গার অংশগ্রহণে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টায় উখিয়ার রাজাপালংয়ের মধুরছড়া ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফুটবল খেলার মাঠে কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় সমাবেশের উদ্বোধন হয়। এখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আগত এক লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। অংশগ্রহণকারীদের হাতে বিভিন্ন ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে ছিল-‘We Want Justice’, ‘Arakan is Our Home’, ‘We Will go Home, World Listen to Us’.
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.