নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ অনেক

স্টাফ রিপোর্টার: ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রবেশ করবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বদলে যাবে বই, বইয়ের ধরণ ও পরীক্ষাপদ্ধতিও। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই থাকবে না। বাদ যাবে অষ্টম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ ভিত্তিক পড়াশোনাও। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়তে হবে। বছর শেষে যে পরীক্ষা হয় তার চেয়ে শ্রেণিকক্ষের ধারাবাহিক মূল্যায়নে জোর দেয়া হবে।
নতুন এই পদ্ধতি ঘোষণার পর থেকেই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-অভিভাবক ও অংশীজনরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে। সর্বশেষ ২০১২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম ঘোষণা হয়। ২০১৩ সাল থেকে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হয়, যা বর্তমানে চলছে। নতুন ঘোষিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২৩ সাল থেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়গুলো ভালো। সময়ের চাহিদা। কিন্তু বাস্তবায়নের আগে এর চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করে তা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, খুবই ভালো উদ্যোগ। সর্বস্তর থেকেই নতুন শিক্ষাক্রমের দাবি উঠেছিল। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। এক বছর প্রস্তুতি নিয়ে এই পদ্ধতি ভালোভাবে চালু করতে হবে বলে মত দেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, এই শিক্ষাক্রমের ফলে একটি শ্রেণির ব্যবসা নষ্ট হবে। কোচিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। তারা কিন্তু চাইবে বাধাগ্রস্ত করতে। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। আমি দেখেছি শিক্ষকদের প্রবল আগ্রহ আছে। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য আমাদের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। মাঠ পর্যায় থেকে অনেক সমালোচনা আসতে পারে। খোলা মন নিয়ে সরকারের উচিত হবে এই সমালোচনা শোনা এবং ভালো কিছু থাকলে সেখান থেকে গ্রহণ করা।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তায়নের সিদ্ধান্ত ভালো উদ্যোগ। তবে এতে নতুন কিছু নেই। সব বিষয়ই একসময়ে আমাদের দেশে ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে না পারায় পরিবর্তন করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষা আগেও ছিল না। ৩০ বছর আগে এমন ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু দেখা গেছে এটা ভালোভাবে চলছে না। এ কারণে একসময়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার ১৯৬০ সালের দিকে বাংলাদেশে একমুখী শিক্ষা চালু ছিল। সবাইকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের বিষয় পড়তে হতো। কিন্তু একসময়ে এসে নবম থেকেই বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য পৃথক করা হলো। এর মূল কারণ যেভাবে চলার কথা ছিল সেভাবে চলেনি। নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা আগের সেই অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। তবে কেন একমুখী থেকে বহুমুখী শিক্ষা চালু হয়েছিল, কেন প্রথম শ্রেণি থেকেই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয় সেটি জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নে জোর দেয়া হয়েছে। সাধারণ স্কুলেও কারিগরি ট্রেড যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ, ল্যাব ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দিলে এর সুফল আসবে না।
রাজধানীর শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, স্কুলগুলোতে বর্তমানে চারু-কারু কলা ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়গুলো আছে। নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো বাদ দেয়া হয়েছে। তাহলে এই শিক্ষকদের কী হবে? আইসিটি প্র্যাকটিক্যাল নির্ভর। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাস্তবে হচ্ছে না। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। বিভিন্ন শ্রেণিতে ট্রেড চালু ভালো উদ্যোগ, তবে এজন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক ও ল্যাব থাকতে হবে। এজন্য অবকাঠামোও বাড়াতে হবে। বাড়তি অর্থের জোগান দিতে হবে। এই শিক্ষক আরো বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনেক সময় চলে যায়। ফলে এই স্তরে শিক্ষার্থী কম সময় পায়। তাই এই স্তরে দুটি পরীক্ষা নিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
আমিরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, এই রূপরেখায় যেভাবে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন হচ্ছে তা আমাদের মতো সমাজে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। আর দশম শ্রেণিতেও ৫০ শতাংশ। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আর সব শিক্ষক কতটা নিরপেক্ষভাবে এই মূল্যায়ন করবেন, সেটা নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হতে পারে।
নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। ৪র্থ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ৬০ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৪০ শতাংশ নম্বরের। অভিভাবকদের বক্তব্য, শুরুতে এই ধরনের মূল্যায়নে কম নম্বর রেখে বিষয়টি পাইলট আকারে দেখা যেতে পারে। বিষয়টিতে সাফল্য পাওয়া গেলে শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নে ধীরে ধীরে নম্বর বাড়ানো যাবে।
নজরুল আমিন নামে একজন অভিভাবক জানান, শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত করতে হবে। আর তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ লাগবে, আর এই বিনিয়োগে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। সালমা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, কোনো শিক্ষক নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি শিক্ষকদেরও আন্তঃস্কুল বদলির ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More