প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল : উপজেলার অভিন্ন কোড নম্বরেই বিভ্রান্তি

আগের ফল বাতিলের পর নতুনভাবে তৈরি : কতোজন নতুন বৃত্তি পেয়েছে বা বাদ পড়েছে জানা যাবে আগামী সপ্তাহে

স্টাফ রিপোর্টার: প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সংশোধিত ফল বুধবার রাত ১০টার পর প্রকাশ করা হয়েছে। কারিগরি ত্রুটির কারণে মঙ্গলবার এই ফল প্রকাশের ৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থগিত করা হয়। এরপর ৩০ ঘণ্টা ধরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) এ ফল চূড়ান্ত করে। পরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটে) সেই ফলের ‘সঠিকতা’ যাচাই করে। এর আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. ফরিদ আহাম্মদ জানান, বুধবার রাত ১২টার আগেই ফল প্রকাশ করা হবে।

এদিকে কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এভাবে তা বাতিলের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নজর কেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেরও। উভয় দপ্তর থেকে দ্রুত সঠিক ও সংশোধিত ফল প্রকাশের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যদিকে ফল নিয়ে এমন কা-ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি সচেতন মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এমনিতেই সুশীল সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে এই পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। এছাড়া আগে থেকেই পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন আর ফল প্রণয়নের নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ অবস্থায় ফল তৈরিতে কারিগরি ত্রুটি সংশয়কে আরও ঘনীভূত করেছে। এমনকি মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের দপ্তর থেকে ফল ‘কেনাবেচার’ মতো গুজবও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে ফল প্রকাশের পর বাতিল নিয়ে। বিষয়টিকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কা- এবং শিশুদের প্রতি ‘অবিচার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন সমালোচকরা।

তারা মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ আর ফল প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে একদিকে খামখেয়ালিপনা ও তাড়াহুড়া, আরেকদিকে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়ার ঘটনা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আর এসব কারণে এই ভুলের ঘটনা ঘটে। যার বলি হয় শিশুরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং স্থগিত করা উভয় ক্ষেত্রেই তাড়াহুড়ার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এভাবে ভুল ফল প্রকাশ আর তা প্রত্যাহার দুটিই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি করেছে। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় তারা ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন। যেহেতু প্রথম ফলে পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়ার তথ্য এসেছে, তাই এখন প্রকৃত অর্থে কেউ বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও বঞ্চিত হয় কি না, তেমন সংশয় অবশ্যই তৈরি হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন এই ফল তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে আগের ডেটা বা ফল পুরোপুরি বাতিল করা হয়। এরপর বৃত্তি বণ্টনের নীতিমালা অনুযায়ী নতুন করে তথ্য আপলোড করে প্রোগ্রাম চালু করা হয়। এরপরই নতুন ফল দেয় কম্পিউটার। তবে বরাদ্দ টাকা সামনে রেখে বৃত্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ, ৮২ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাবে। যার মধ্যে থাকছে মঙ্গলবারের ঘোষণা অনুযায়ী ৩৩ হাজার ট্যালেন্টপুলে আর ৪৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি। এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থী মনোনয়নে। সঠিক কোড ব্যবহার করায় রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বরও সংশোধন হয়। আগে পরীক্ষা না দেয়া শিক্ষার্থী এবং তাদের রোল নম্বর বাদ দেয়া হয়। পাশাপাশি ফেল করা শিক্ষার্থীদের আলাদা চিহ্নিত করা হয়। এরপর নীতিমালা অনুসারে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ডেটা ধরে কম্পিউটারকে ফল দিতে অর্ডার দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় চূড়ান্ত ফল। সূত্র জানায়, ভুল ফল তৈরির ক্ষেত্রে মূলত তাড়াহুড়া আর সময়স্বল্পতা মুুুুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া উপজেলা যে কোড তৈরি করেছে, তা ডিপিইকে জানানো হয়নি। ফল তৈরির ক্ষেত্রে অভিন্ন কোড নম্বর লক্ষ্য করা গেলে তা পরিবর্তন করা যেত। আর এতে সফটওয়্যারের ‘মাথা’ নষ্ট হতো না।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিপিই-এর কম্পিউটার সেলের প্রধান প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় বলেন, মূল সমস্যা হয়ে গেছে উপজেলা পর্যায়ে ফল তৈরির কারণে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার ফল তৈরি হতো উপজেলায়। সেখান থেকে আসা ফল নিয়ে কাজ করে ডিপিই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করত। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ওই কাজ করলে তেমন ভুল হয় না। এক্ষেত্রে উপজেলা অনুযায়ী নতুন কোড দিয়ে ডেটা বিশ্লেষণ করার সময় পাওয়া যেত। কিন্তু বিভিন্ন উপজেলা নিজস্ব পদ্ধতিতে কোড তৈরি করে ফল প্রস্তুত করে। এতে একই কোড একাধিক উপজেলা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পেয়ে গেছে। সেই কোড একটির সঙ্গে আরেকটি মিলে যাওয়ায় ভেতরের ডেটা প্রভাবিত হয়। কম্পিউটার সেই ডেটা নিয়ে নিজের মতো কাজ করে। তিনি আরও বলেন, এরপরও ভুলের ঘটনা যেখানে বা যাদেরই হোক না কেন, প্রধান হিসাবে এর দায় আমার ওপরই বর্তায়। তবে গোটা ত্রুটিই অনিচ্ছাকৃত।

জানা যায়, বৃত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে মূলত দুটি নিয়ম অনুসরণ করা হয়। একটি হচ্ছে, ৩৩ হাজার ট্যালেন্টপুল (মেধা) বৃত্তি, যা উপজেলা বা পৌরসভাভিত্তিক বণ্টন করা হয়। সারা দেশের মোট ছাত্র-ছাত্রীকে উপজেলা বা পৌরসভার শিক্ষার্থী সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। এতে যে ফল বা সংখ্যা আসে, সেটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা পৌরসভার মোট ট্যালেন্টপুল বৃত্তি। এরপর ওই উপজেলা/পৌরসভার সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের মেধাতালিকা অনুযায়ী বৃত্তি বণ্টন করা হয়। দ্বিতীয়ত, সাধারণ গ্রেডের বৃত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সারা দেশের উপজেলার ক্ষেত্রে মোট ইউনিয়ন আর পৌরসভার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড সংখ্যার সমষ্টিকে ৬ দিয়ে গুণ করা হয়। এরপর প্রতি ইউনিয়ন (উপজেলা) ও ওয়ার্ডে (পৌরসভা) ৩ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়েকে বৃত্তি দেয়া হয়। যদি কোনো ইউনিয়নে ছেলে বা মেয়ের সংখ্যা এর কম থাকে, তাহলে বিপরীত লিঙ্গের শিক্ষার্থীকে বাছাই করা হয়। যদি কোনো ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে কৃতকার্য কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে সেই বৃত্তি (৬টি) চলে যায়। সাধারণ গ্রেডে বৃত্তির ক্ষেত্রে ৮ হাজার ১৪৫টি উপজেলা ইউনিয়ন/ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৬টি (৩ জন ছাত্র ও ৩ জন ছাত্রী) হিসাবে ৪৮ হাজার ৮৭০টি বৃত্তি দেওয়া হয়। অবশিষ্ট ৬৩০টি বৃত্তি থেকে প্রতিটি উপজেলা/থানায় ১টি করে ৫১৩টি উপজেলা/থানায় ৫১৩টি সাধারণ বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। বাকিটা দেওয়া সম্ভব হবে না।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ঝিনাইদহ, রাউজান, চাঁদপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি উপজেলার একই কোড নম্বর ধরা পড়ে। এর ফলে সৃষ্ট গোলযোগ থেকে এক শিক্ষার্থীর তথ্য আরেকজনের রেজিস্ট্রেশন নম্বরে চলে যায়। এতেই কেউ কেউ পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পেয়ে যায়। আবার ভালো পরীক্ষা দিয়েও বৃত্তি না পাওয়ার ঘটনা চিহ্নিত হয়। সূত্র জানায়, কতজন ফেল করা বা ভুলক্রমে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী চূড়ান্ত ফলে বাদ পড়েছে কিংবা নতুন করে কতজন বৃত্তি পেয়েছে বা কতটি উপজেলার কোড একটির সঙ্গে আরেকটি মিলে গেছে, তা রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় বলেন, বিষয়টি ম্যানুয়ালি শনাক্ত করতে হবে। আগামী সপ্তাহে এ তথ্য জানা যাবে।

প্রসঙ্গত, ফল প্রকাশে এমন ঘটনার কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে ডিপিই পরিচালক উত্তম কুমার দাশকে প্রধান করে মঙ্গলবারই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রাথমিকভাবে কোডিং সমস্যার কারণেই ফলে ত্রুটির কারণ চিহ্নিত করেছে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি এই কমিটি।

মন্ত্রণালয় জানায়, বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে (িি.িফঢ়ব.মড়া.নফ), মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট (িি.িসড়ঢ়সব.মড়া.নফ) স্থানীয়ভাবে বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয়, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় এবং উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় থেকে পাওয়া যাবে।

গত বছরের ২৮ নভেম্বর হঠাৎ প্রাথমিক ও গণশক্ষিা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর মাত্র ২৮ দিন সময় পায় মাঠ প্রশাসন প্রস্তুতির জন্য। ৩০ ডিসেম্বর একযোগে সারা দেশে এই পরীক্ষা হয়। এতে ৫ লাখ ৩৯২ জন নিবন্ধন করলেও অংশ নেয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ জন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More