ফের ‘গিনিপিগ’ হতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা : নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্লাসে যাবেন শিক্ষকরা

নতুন শিক্ষাক্রম পাঠ্যবই প্রবর্তন : সার্ভার জটিলতায় প্রথম দিন এক লাখ শিক্ষক ওরিয়েন্টেশন শেষ করতে পারেননি

স্টাফ রিপোর্টার: নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর লেখা পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে আগামী বছর দেয়া হচ্ছে। অতীতের কোনো ধরনের শিক্ষণ (টিচিং), শিখন (লার্নিং) এবং মূল্যায়ন (পরীক্ষা) পদ্ধতির সঙ্গে মিল নেই এর। তাই শুধু শিক্ষার্থী-অভিভাবক নন, শিক্ষকরাও পরিচিত হবেন নতুনের সঙ্গে। এজন্য শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে শিক্ষকদের প্রস্তুত করা জরুরি। কিন্তু নামমাত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে ক্লাসরুমে। ফলে দেড় দশক আগে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতির মতোই শিক্ষার্থীদের ‘গিনিপিগে’ পরিণত হতে হচ্ছে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। অবশ্য প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন, মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবার চালু হচ্ছে নতুন পাঠ্যবই। এ দুই শ্রেণির পাঠদানে ৪ লাখ ১৮ হাজার শিক্ষক আছেন। তাদেরকে এখন নতুন পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে পরিচিত করার লক্ষ্যে অনলাইনে ‘ওরিয়েন্টেশন’ দেয়া হচ্ছে। এটি শুরু হয়েছে শনিবার। রোববারই এই কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা। পরে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের ৬ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণকে নামমাত্র বলা হচ্ছে দুই কারণে। প্রথমত, শনিবার অনলাইনে যে ওরিয়েন্টেশন শুরু হয়েছে তা এক ঘণ্টার। এদিন পৌনে ২ লাখ শিক্ষক প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সার্ভার জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত ৭৫ হাজারের মতো কাজ শেষ করতে পেরেছিলেন। অবশিষ্ট ১ লাখই ওরিয়েন্টেশন শেষ করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ৬ জানুয়ারি এসব শিক্ষককেই ৬ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে উপজেলা পর্যায়ে। তাই এক ঘণ্টার ওরিয়েন্টেশন আর ২-৩ ঘণ্টার প্রশিক্ষণে দেশে একেবারেই নতুন ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই’ কতটা সফলতার সঙ্গে পাঠদান করতে শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব হবে, সেটি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কেননা ২০০৮ সালে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি ১৪ বছর পর এখনো দেশের ৩৮ শতাংশ শিক্ষক বোঝেন না।

নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান। তিনি বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে নতুন পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করছে শিক্ষকদের ওপর। সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষকের কাছে কঠিন মনে হওয়ার কারণ ছিল এখানে শিক্ষককেই প-িত হতে হয়েছে। তাকে ‘সমালোচনামূলক চিন্তাশীল’ হতে বলা হয়েছে, যা অনেক শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের নোট-গাইডনির্ভর হতে হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিতে শিক্ষকের ভূমিকায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে তিনি কেবল কাজ দেবেন আর নেবেন। এই কাজটি কীভাবে করতে হবে, সেটিই তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এজন্য তাদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এনে উপজেলায় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পাশাপাশি ৬ ঘণ্টার প্রশিক্ষণেও যদি তারা বিষয়টি না বোঝেন তাহলে তিনি আবার প্রশিক্ষণ নেবেন। বছরব্যাপী চার ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ভিডিও রাখা থাকবে অনলাইনে। পাশাপাশি তাদের জন্য পরামর্শক রাখা হবে। মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তা, এনসিটিবি কর্মকর্তার সমন্বয়ে ওই পরামর্শক টিম থাকবে। তবে এটা ঠিক যে, শিক্ষক আন্তরিক না হলে কখনোই তিনি নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান শিখতে পারবেন না।

জানা যায়, রোববারও সারা দেশের শিক্ষকদের অনলাইন ওরিয়েন্টেশন দেয়া হয়। বিকেল ৪টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২ লাখ ২২ হাজার শিক্ষক কাজটি শেষ করেছেন। আরও অন্তত ২ লাখ বাকি আছে। দুদিনেও শেষ করতে না পারায় এখন সময় বাড়াতে হচ্ছে। আরও জানা যায়, সব ধরনের মাধ্যমিক স্কুল, মাদরাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান এবং ৬৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (এসব প্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়) ৪ লাখ ১৮ হাজার শিক্ষককে এখন ওরিয়েন্টেশন দেয়া হচ্ছে নতুন পাঠ্যবইয়ের ওপর। এই কাজে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ভিত্তিক প্রকল্প এটুআই। প্রশিক্ষণের মডিউল তৈরি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড; যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অধিদপ্তরের অধীন। কারিগরি ও মাদরাসা অধিদপ্তরের পক্ষে সব ধরনের শিক্ষককে মাউশি ওরিয়েন্টেশনের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু সব শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেননি বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে মাউশির পরিচালক অধ্যাপক প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন, প্রত্যেক শিক্ষকের এই ওরিয়েন্টেশন নেয়া বাধ্যতামূলক। পরে প্রশিক্ষণও বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে। নইলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। কেননা পাঠ্যবই সম্পর্কে এখন তাদের ধারণা দেয়া হচ্ছে। এর আগে তাদেরকে শিক্ষাক্রমের (যার ভিত্তিতে বই লেখা হয়) ধারণা দেয়া হয়। এ দুটি ধারণা কারও মধ্যে না থাকলে পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণে কিছুই বুঝবে না। তাই যেহেতু সব শিক্ষক রোববারের মধ্যে ওরিয়েন্টেশনে যুক্ত হতে পারেননি, তাই আমরা এটি আরও দুদিন চালিয়ে যাব। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে এ ব্যাপারে নোটিশ দেয়া হচ্ছে।

১ জানুয়ারি তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে লেখা পাঠ্যবই পড়ানো শুরু হবে। এগুলো হচ্ছে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি। উপজেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেনার পাঠাতে জেলায় জেলায় প্রতি বিষয়ে ৩ জন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তাই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১১টি বিষয়ের ওপর ৩৩ জন মাস্টার ট্রেনার তৈরি করা হবে। তাদেরকে জেলায় ট্রেনিং দেয়া হবে। আজ সোমবার শুরু হবে এই ট্রেনিং। ঢাকা থেকে গিয়ে জাতীয় মাস্টার ট্রেনাররা তাদের ট্রেনিং দেবেন। এরপর জেলার মাস্টার ট্রেনাররা আগামী মাসে উপজেলায় গিয়ে ট্রেনিং দেবেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দ হিসাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই টাকা নিয়েছে বলে জানা গেছে।

নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হবে। এতে বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। আর ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিও আগামী বছর বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষকরা কীভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন, সেই প্রশিক্ষণ এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি এই স্তরের শিক্ষকদের। শুধু তাই নয়, প্রথম শ্রেণিতে কী নতুন বই যাচ্ছে, সেটি নিয়েও লুকোচুরি করা হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক স্তরে পাঠদান আর মূল্যায়ন নিয়ে সংকট তৈরির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন ও সামস্টিক পরীক্ষা দুটিই থাকছে। এখনকার মতো নবম-দশম শ্রেণির লেখাপড়ার ওপর এসএসসি পরীক্ষা হবে না। কেবল দশম শ্রেণির পাঠের ওপর এসএসসি হবে। আর এইচএসসি পরীক্ষাও একাদশ-দ্বাদশের লেখাপড়ার ওপর হবে না। একাদশ ও দ্বাদশে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। দুটির ভিত্তিতে দেয়া হবে শিক্ষার্থীর ফল। নতুন বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে দুদিন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More