বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছুটছে মানুষ

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যাত্রীর চাপে চলেছে ফেরি : ফেরিঘাটে বিজিবি মোতায়েন
স্টাফ রিপোর্টার: করোনার সংক্রমণ রোধে ঈদযাত্রাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে ঈদুল ফিতরের ছুটি হওয়ার আগেই রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন হাজারো মানুষ। গতকাল শনিবারও তাদের সেই যাত্রা অব্যাহত ছিলো। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে তারা রাজধানী ছেড়েছেন বিশেষ কায়দায়। সে জন্য গুনতে হয়েছে তিনগুণ বেশি ভাড়া। তার পরও তারা বলেছেন, যে কোনো মূল্যেই ফিরতে হবে বাড়িতে। এদিকে শুক্রবার গভীর রাতে মাওয়া ও আরিচায় ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। শুধু রাতে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের জন্য ফেরি চলানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু মানুষের চাপে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। গতকাল দিনের বেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ফেরিতে উঠে চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা ফেরি চালান। তবে কোথাও মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। একপর্যায়ে রাতে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
ট্রেন, লঞ্চ স্টিমার ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন জেলার মানুষ যানবাহন পালটে ভেঙে ভেঙে, অনেকে হেঁটেই যাত্রা করেছেন। আগাম ঘোষণা ছাড়াই শনিবার সকাল থেকে হঠাৎ ফেরি বন্ধ করে দেয়ায় ঘাটগুলোয় ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। অনেকে অভিযোগ করেন, ফেরি চলবে না, আগে জানলে আসতাম না।
করোনার সংক্রমণ রোধে ঈদযাত্রাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে ঈদুল ফিতরের ছুটি হওয়ার আগেই রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন হাজারো মানুষ। গতকাল শনিবারও তাদের সেই যাত্রা অব্যাহত ছিলো। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে তারা রাজধানী ছেড়েছেন বিশেষ কায়দায়। সে জন্য গুনতে হয়েছে তিনগুণ বেশি ভাড়া। তারপরও তারা বলেছেন, যে কোনো মূল্যেই ফিরতে হবে বাড়িতে। এদিকে শুক্রবার গভীর রাতে মাওয়া ও আরিচায় ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। শুধু রাতে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের জন্য ফেরি চলানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু মানুষের চাপে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়নি। গতকাল দিনের বেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ফেরিতে উঠে চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা ফেরি চালান। তবে কোথাও মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। একপর্যায়ে রাতে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
দিনের একপর্যায়ে যাত্রীদের চাপে ফেরি ছাড়লেও তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। ফেরিতে ‘তিল ধারণের’ জায়গা ছিলো না। যাত্রীদের চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এই ভিড় থেকেই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঈদের দুই সপ্তাহ পর এর প্রকাশ ঘটতে পারে।
সরেজমিন মাওয়া ও আরিচা ঘাটে দেখা গেছে, হাজার হাজার যাত্রী রোজা রেখে রোদের মধ্যে ফেরির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। কখন চলবে বা আদৌ ফেরি চলবে কি না, কেউ জানেন না। এরপরও ঘাট ছাড়ছেন না কেউ। এ সময় হঠৎ ফেরি বন্ধ করায় অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তারা বলছে, এতো এতো টাকা দিয়ে কষ্ট করে ঘাটে এসে দেখি ফেরি বন্ধ। আগে ঘোষণা দিলে আমরা আসতাম না। এতো কষ্ট করতে হতো না। ঢাকায় বসবাস করা ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বাড়ি ফেরার জন্য সকাল থেকেই মাওয়া ও আরিচা ঘাটে জমা হতে থাকেন। তারা এসে দেখেন ফেরি বন্ধ। ফলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়তে থাকে। খোলা আকাশের নিচে রোদের মধ্যে বেশি দুর্ভোগে পড়েন বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশু। দুপুরের পর ফেরি চালুর সিদ্ধান্ত এলে মানুষ ঘাটের পল্টুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকেই ঘাটে বাঁধা দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে ফেরির পল্টুনে উঠেন। হাঁটুর চেয়ে বেশি পানি ভেঙে অনেক মহিলাকেও রেলিং বেয়ে ফেরিতে উঠতে দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এভাবে দেশের সর্বত্র মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই শঙ্কা বাড়ছে। আসন্ন ঈদের আগে জেলার অভ্যন্তরের গণপরিবহণ চলাচলের বিধান শিথিল না করে ঈদের পরে করলে এ ঝুঁকি এড়ানো যেতো। তারা বলেন, ফেরিঘাটগুলোয় যা হলো, এটা এড়ানো যেতো। হঠাৎ ফেরি বন্ধ না করে চলাচল অব্যাহত রাখলে যাত্রীর চাপ বাড়তো না। অথবা দূরপাল্লার বাস চালু থাকলে যাত্রীরা ঢাকা থেকে সোজা গন্তব্যে পৌঁছাতো। ভাইরাসটি রাস্তায় রাস্তায় ছড়ানোর ভয় থাকতো না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা ঢাকা ছাড়ছেন, তাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। নইলে করোনা সংক্রমণ বর্তমানের অবস্থার চেয়ে বেড়ে যেতে পারে।
সরেজমিন দেখা যায়, ঈদুলফিতর সামনে রেখে গ্রামে ফিরছেন হাজারও মানুষ। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও তারা পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে রাজধানী ছাড়ছেন বিশেষ কায়দায়। যানবাহন পালটে, পথে পথে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নানাভাবে গন্তব্যে যাচ্ছেন। কেউ ভাড়ায় কার, মাইক্রোবাস, ছোট ছোট ট্রাক, মোটরসাইকেল নিয়ে রওয়ানা হয়েছেন। কুমিল্লা যেতে সাধারণ সময়ের ২০০ টাকার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৬০০ টাকা। ফেনী যেতে ৩০০ টাকার ভাড়া দিতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা। আর নোয়াখালী যেতে ৭০০ টাকার ভাড়া শনিবার ২ হাজার টাকা দিয়েও গেছেন অনেকে। এরপরও তাদের বাড়ি ফেরাতেই স্বস্তি।
সায়েদাবাদে কথা হয় কুমিল্লাগামী যাত্রী সাইদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মিরপুর। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে কুমিল্লা যাবো। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় ভাড়া করা গাড়িতে বাড়ি যাচ্ছি। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া নিয়েছে। নিরুপায় হয়ে গাড়িটি ভাড়া নিয়েছি। যাত্রাবাড়ীতে কথা হয় প্রাইভেট কারের চালক নূরে আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় যাত্রীর চাপ আছে। তবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে যাত্রী আনা-নেয়া করতে হয়। পুলিশ জানলে মামলা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাবে। সেজন্য আমরা বাড়তি ভাড়া নিচ্ছি। তাছাড়া রাস্তায় পুলিশ ধরলে টাকাপয়সা দিতে হয়।
সরেজমিন আরও দেখা যায়, রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার এলাকা দিয়ে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে চেপেই যাত্রীরা যাচ্ছেন আরিচা-পাটুরিয়া ঘাটের দিকে। প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। প্রশাসনের তৎপরতায় যাত্রীদের গাবতলী থেকে হেঁটে আমিনবাজার গিয়ে ঘাটের গাড়ি ধরতে হচ্ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইমদাদুল হক যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। তিনি বলেন, বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। অফিস অনেককে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে আমিও আছি। ছুটি যেহেতু পেয়েছি, সেহেতু বাড়ি যাচ্ছি ঈদ করতে। তবে অতিরিক্ত ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করে আবার ঢাকায় ফিরবো।
এদিকে শনিবার রাজধানীতেও মানুষের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। গণপরিবহন চলাচল করেছে যথারীতি। সিগন্যালগুলোয় ১০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা যানজটের কবলে পড়েছেন অনেকেই। মানুষের চলাচল বেশি-এমন এলাকার সড়কগুলোয় গাড়ির জট ছিলো। আর কেনাকাটা করতে আসা মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে খুবই কম। কেউ মাস্ক পরেছেন, কেউ পরেননি। অনেক দোকানে সামাজিক দূরত্বও রক্ষা করা হয়নি।
মোহাম্মদপুর টাউন হল নতুন কাঁচাবাজার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার দোকানদার ইমরান হোসেন মাস্ক ছাড়াই ব্যবসা করছেন। তার সঙ্গে আরও দুজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা শুরুর পর থেকে কোনোদিন মাস্ক পরিনি। কই আমার তো করোনা হয়নি। এটা আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি চাইলে হবে, নইলে হবে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সরকার চায়, জনগণকে বাড়ি যেতে নিরুৎসাহিত করতে। এজন্য বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে। এরপরও যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন, তাদের উচিত হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করা। আর যারা যেতে চান, তাদের তো আটকে রাখা যাবে না। তবে সরকার চাইলে এখন সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ঈদের আগে গণপরিবহন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে। সরকার চাইলে ঈদের পর পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। তাহলে ঈদের সময়ের এ ঝুঁকিটা এড়ানো যেতো।
তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এসব কারণে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত যাথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পরিস্থিতির অবনতিও হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঈদে ঘরমুখো হাজারও মানুষ গ্রামে যাচ্ছে। যাত্রাপথে তারা সংক্রমণ ছড়াতে ছড়াতে যাবে। করোনায় আক্রান্ত মানুষ গ্রামেও সংক্রমণ ছড়াবে। ঈদ-যাত্রার কারণে করোনা সংক্রমণ খুব বেশি না ছড়ালেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেকাংশে বাড়বে বলে মনে হয়। ঈদ-পরবর্তী সময়ে এটার বিশ্লেষণে বিষয়টি আমরা আরও পরিষ্কার হতে পারব।
সামগ্রিক বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘লকডাউন’ দিয়ে দোকান খুলে দিলে তো আর কার্যকর সুবিধা মিলবে না। যে কয়দিন লকডাউন দিয়েছে, সবকিছু মেনে চলতে পারলে অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যেতো।
তিনি বলেন, লকডাউন মূলত অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের মতো, শেষ করতে হয়, নইলে ক্ষতির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে আরও জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আমার মনে হয়, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে স্বল্পপরিসরে দূরপাল্লার গণপরিহন চালু করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। তাহলে একদিকে মানুষের দুর্ভোগ কমবে, অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করলে করোনা সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। নইলে মানুষ যেভাবে গ্রামে ছুটছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More