বিক্রি না হওয়া গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে খামারিরা

স্টাফ রিপোর্টার: খামারিদের যারা বড় গরু বাজারে এনেছিলো তাদের প্রায় ৫০ শতাংশই অবিক্রিত রয়েছে। চড়া দামের খাবার খাইয়ে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে যারা খামার করেছে তাদের অবস্থা শোচনীয়। খামার পরিচালনার দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতেই এখন এদেরকে পথে বসতে হবে।
এবারে কোরবানির ঈদে পশু বিক্রি করতে না পেরে বিপাকে পড়েছে হাজার হাজার খামারি। এদের অনেকেই বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে সারাবছর পশু পালন করেছিল এই সময়টাতে বিক্রির উদ্দেশ্যে। করোনার প্রভাবে চাহিদা কম থাকায় এই অবস্থার তৈরি হয়েছে।
মানিকগঞ্জ, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের খামারি ও মৌসুমি পশু ব্যবসায়ী, টিবিএসের জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা ছিল বেশি। যে তুলনায় বড় গরুর ক্রেতা ছিল যৎসামান্য। ফলে যারা বড় গরু বিক্রির জন্য ঢাকার বাজারগুলোতে এসেছিল তাদের ৫০-৯০ শতাংশ পশুই অবিক্রিত থেকে গেছে। তবে ঢাকায় বিক্রি জন্য আনা খামাড়িদের গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ গরু অবিক্রিত রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, কোরবানি উপযোগী গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। তবে কি পরিমাণ গরু বিক্রি হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনো হাতে পায়নি অধিদপ্তর। পরিসংখ্যান যাই আসুক কোরবানি আগের তুলনায় অনেক কমেছে বলেই ধারণা খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি গরু প্রস্তুত ছিল। এর মধ্যে বিক্রি হয়েছিল ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। গত বছরও করোনার কারণে পশু কোরবানি কম হয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যথাক্রমে এক কোটি সাড়ে পাঁচ লাখ ও ১ কোটি ছয় লাখ ছাড়িয়েছিল কোরবানির সংখ্যা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কয়েকটি কারণে গরুর চাহিদা কম ছিল। করোনায় অনেকের ব্যবসা বন্ধ, অনেকে চাকরি হারিয়েছে। ফলে অনেক মানুষের হাতে টাকা ছিল না। অন্যদিকে করোনার সংক্রমণের কারণে অনেকে কোরবানি করেনি। অনেক শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতারা একাধিক পশু কোরবানি গোশত বিলি করতো যেটা এবারে অনেক কম ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, “বড় শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতারা আগে ৫-৬টা করে গরু কিনতো। কিন্তু এবারে হয়তো তারা একটা গরু কোরবানি করেছে। পাড়া-মহল্লায় বড় গরু কিনে শো-অফের ব্যাপারটা এবার ছিল না। হয়তো যারা দলবল নিয়ে গরু কিনতো তারা এবার করোনার ভয়ে হাটেই যায়নি”।
তিনি বলেন, “রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিরা বড় গরু কিনতো এবং মাংস অন্যান্যদের মাঝে বিলিয়ে দিত। করোনার কারণে এবার সে অবস্থা ছিল না। অন্যদিকে মানুষের হাতে টাকা কম থাকায় অনেকে হয়তো কোরবানিই দেয়নি”।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের বাসার ডেইরি ফার্ম গাবতলী হাটে ৪২টি গরু আনে। ফার্মটির মাত্র একটি গরু বিক্রি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মতিয়া রহমান বলেন, ‘খরচের চেয়েও কম দামে গরুটি বিক্রি করতে হয়েছে, তাও শুধুমাত্র যাতায়াত খরচ ও শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার খরচ যোগানোর জন্য’।
তিনি বলেন, ‘ঈদের দুইদিন আগে গরুর দাম পড়ে যায়। সে অনুযায়ী বিক্রি করলে প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। আর বাড়ি নিয়ে গেলে বাড়তি ৩ লাখ টাকা খরচ পড়বে। যে কারণে ফিরিয়ে এনেছি’।
এই খামারির মাথার ওপর এখন ১ কোটি টাকা ঋণের বোঝা ঝুলছে, যা হাটে গরু বিক্রি করে পরিশোধের চিন্তা ছিল।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ‘বাবু ক্যাটেল এগ্রো’র মালিক ওমর ফারুক গাবতলী হাটে ৬০টি গরু এনেছিলেন যেখান থেকে বিক্রি করেছেন ১০টি। তিনি বলেন, ‘তিন লাখ টাকার গরু এক বছর পালনের পর যদি দুই লাখ টাকা দাম চায় তাহলে সেটা বিক্রি করা যায় না।” তিনি জানান, ৫০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে সারাবছর গরু পালন করেছেন কোরবানির সময় বিক্রি করবেন বলে।
শুধু খামারিরাই নয়, এবার বড় ধরনের চাপে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। যারা সারাদেশের বিভিন্ন খামার থেকে গরু কিনে ঢাকায় আনেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারাও এবার লাভের মুখ দেখতে পারেননি।
খামারি, ব্যবসায়ী, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ এ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর পশু কোরবানি অন্যান্য বছরের চেয়ে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে বেশি-কম হতে পারে। তবে এর এখনো কোন সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা: শেখ আজিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ‘পরিসংখ্যানটি এখনো তৈরি হয়নি। আগামী সপ্তাহে এটি জানা যাবে’।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন (বিডিএফএ) এর সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ এমরান টিবিএসকে বলেন, ‘খামারিদের যারা বড় গরু বাজারে এনেছিল তাদের প্রায় ৫০ শতাংশই অবিক্রিত রয়েছে। চড়া দামের খাবার খাইয়ে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে যারা খামার করেছে তাদের অবস্থা শোচনীয়। খামার পরিচালনার দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতেই এখন এদেরকে পথে বসতে হবে।’ তবে তিনি বলেন, ছোট ও মাঝারি গরুর বেশিরভাগই বিক্রি হয়েছে।
অন্যান্য বছরের মত এবারে ঢাকার বাজারগুলোতে ভারতীয় গরু দেখা যায়নি বলেও জানান খামারিদের এই নেতা।
খামারিরা বলছেন, যারা গরু বিক্রি করতে পারেনি, উল্টো ঢাকায় এসে বাড়তি কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে তাদের এখন গরু পালন করতেই হিমশিম খেতে হবে। কারণ আগের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করলে নতুন ঋণও পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে গো-খাদ্যের দাম ব্যাপক চড়া।
সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে জমানো টাকা ও কিছু জমি বিক্রি করে নরদিংদীতে রফিকুল ইসলাম ‘আল ইয়াসিন এগ্রো’ খামার দিয়েছিলেন। তিনি ঢাকার হাজারীবাগ হাটে ২৬টি গরু এনেছিলেন। যে গরুর পেছনে খরচ হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা তা বিক্রি করেছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। ছয়টি গরু আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন খামারে।
তিনি বলেন, লোকসান দিয়ে গরু বিক্রি না করে উপায় ছিল না। কারণ বাড়ি নিয়ে এতগুলো গরু পালন করার মত অবস্থা আমার ছিল না।
শুধু খামারিই নয়, শোচনীয় অবস্থা মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরও। মেহেরপুরের আব্দুল খালেক প্রতি বছরই গরু কিনে ঢাকায় এনে বিক্রি করে। তিনি বলেন, “আমাদের গরু পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে, উপায় ছিল না। ঢাকায় যে গরু এসেছে তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। বাকিগুলো ফেরত নিতে হয়েছে”।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে খামারির সংখ্যা ছয় লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি।
তবে হাটগুলোতে গরু বিক্রি না হলেও এবারে অনলাইনে প্রচুর গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অনলাইন হাটে ঈদের আগের ১৯ দিনে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৯ টি পশু বিক্রি হয়েছে। যার মূল্য ২ হাজার ৭৩৫ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More