বড় পরিবর্তন আসছে করে : উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য

আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার: রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী বাজেটে করহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী যেমন: প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, টয়লেট টিস্যু, কলম, মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। নিম্ন-আয়ের মানুষের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে ন্যূনতম করের প্রস্তাব থাকছে। এছাড়াও ডলার সাশ্রয়ে এবং শুল্ক ফাঁকি রোধে কাজুবাদাম, খেজুরের মতো খাদ্যসামগ্রীর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আয়ে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে, প্রায় ৩৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা হলে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ২৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। এই বিশাল পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করজাল বাড়ানোর পাশাপাশি করহার বাড়ানোর দিকে এগোচ্ছে। প্রতিবছর বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে এনবিআর পণ্যের শুল্ক-কর ও ভ্যাট হ্রাস-বৃদ্ধি করে থাকে। এতে বাজারে ওইসব পণ্যের দাম বাড়ে-কমে। কর আদায় বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে বাজেটে নিত্যব্যবহার্য বেশ কয়েকটি পণ্যের করহার বাড়ানো হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই সেসব পণ্যের দাম বাড়বে। আবার কিছু পণ্যের কর কমানো হচ্ছে, যদিও সেই তালিকা একেবারেই ছোট। সব মিলিয়ে আগামী বাজেটে জীবনযাত্রার খরচ বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গৃহস্থালিসামগ্রী দিয়ে তালিকা শুরু করা যাক। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। একই হারে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালিসামগ্রী ও তৈজসপত্রের (হাঁড়িপাতিল, থালাবাসন) ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিসু, ন্যাপকিন টিসু, ফেসিয়াল টিসু/পকেট টিসু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে টিসু পেপারের দাম বাড়তে পারে।

শহরে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাড়িতে খাবার গরম করতে মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহার করে থাকে। শুল্ক ফাঁকি রোধে বাজেটে সব ধরনের ওভেন আমদানির শুল্ক ৩০ শতাংশ বাড়াচ্ছে, মোট করভার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ করছে। এতে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে। যদিও দেশে ওভেন উৎপাদনের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া আছে, তাই আগামী দিনে দেশি ওভেন ব্যবহারের চিন্তা করলে খরচ কমবে। এছাড়া সারা দেশে রান্নার কাজে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়। বাজেটে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে বাজারে সিলিন্ডারের দাম বাড়তে পারে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বা উৎসব-পার্বণে বিরিয়ানি, তেহারি খেতে পছন্দ করেন অনেকে। এই শখের খাবার খেতেও বাড়তি খরচ করতে হবে। কারণ, বিরিয়ানি-তেহারির প্রধান উপকরণ বাসমতী চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে চালের দাম বাড়তে পারে। সুস্বাস্থ্যের জন্য বাদাম-খেজুর খান অনেকে। বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। মূলত শুল্ক ফাঁকি রোধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফল ও বাদামের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে বিধায় ফল ও বাদামের দাম বাড়তে পারে।

ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করাই ভালো। বাজেটে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নিম্নস্তরের এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের (হলিউড, ডার্বি) দাম ৯০ টাকা, মধ্যমস্তরের (স্টার, নেভি) ১৩৪, উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ২২৬ এবং অতি উচ্চস্তরের (বেনসন, মালবোরো) সিগারেটের দাম ৩০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে জর্দা-গুলের দামও। বিড়ির দাম অপরিবর্তিত থাকবে।

প্রতিবছর মোবাইল ফোন পালটানো ফ্যাশনের অংশ, যা শখে পরিণত হয়েছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফ-এর পরামর্শে মোবাইল ফোনকে বিলাসী পণ্য বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আছে, সেখানে ২ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। আর সংযোজন পর্যায়ে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।

এছাড়া বাচ্চার জন্য কলম কেনার খরচও বাড়বে। কলম উৎপাদনে বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে কলমের দাম বাড়তে পারে। চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়াও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে। সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। সিরিশ কাগজ আমদানিতেও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ভাঙা জিনিস জোড়া দেওয়ার আঠা বা গুল সংরক্ষণমূলক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে।সন্ন বাজেট বাড়ি নির্মাণের খরচ বাড়াবে। বাড়ি নির্মাণের প্রধান উপকরণ সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ক আছে, এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হচ্ছে। এ কারণে সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদেশি টাইলস আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ কারণে বিদেশি টাইলসের দাম বাড়তে পারে।

অবশ্য কমার তালিকা একেবারেই ছোট। মিষ্টির দাম কমতে পারে। কারণ মিষ্টির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু পণ্যের ভ্যাট কমানো হচ্ছে।

অন্যদিকে ধনীদের ছাড় দিয়ে নিম্ন-আয়ের মানুষকে করজালের মধ্যে আনার ছক থাকছে বাজেটে। কারণ, শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে আগে রিটার্ন জমা দেওয়া গেলেও আগামী দিনে সিøপ (প্রাপ্তিস্বীকারপত্র) পেতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর রিটার্ন জমার সিøপ না নিলে সঞ্চয়পত্র কেনা এবং ব্যাংক ঋণ নেয়া যাবে না। ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৪৪ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে না।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More