ভয়াল ২১ আগস্ট আজ : নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দেড়যুগ

স্টাফ রিপোর্টার: ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দেড় যুগ পূর্ণ হলো আজ। এ মামলায় ইতোমধ্যে নিম্ন আদালতে চার্জশিটভুক্ত ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। তবে আসামিরা আপিল করায় মৃত্যুদ-ের রায় এখনো কার্যকর হয়নি। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ইতোমধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতিকে চিঠিও দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। শিগগিরই রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানি হাইকোর্টে শুরু হবে বলে জানা গেছে।

মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা রাষ্ট্রীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। নজিরবিহীন ওই হামলার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থবির ও ধ্বংসের চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। সে কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর দরখাস্ত করেছি।

প্রধান বিচারপতি মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, ‘আশা করছি সেপ্টেম্বরে অবকাশ শেষে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানি হাইকোর্টে শুরু হবে। মামলায় বিচারিক আদালতে আসামিদের যে সাজা হয়েছে তা বহাল রাখতে হাইকোর্ট শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আইনগত দিক তুলে ধরবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মৃত্যুদ-াদেশ নিশ্চিত করার জন্য বিচারিক আদালত থেকে যে রেফারেন্সগুলো হাইকোর্টে আসে, তা শুনানির জন্য প্রস্তুত হলে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ ঠিক করে দেন। সে অনুযায়ী শুনানি হয়।

সেদিন যা ঘটেছিলো: ২০০৪ সালের এই দিনে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। এর মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা ও সাংবাদিকসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ ওই দিন পরিণত হয়েছিলো মৃত্যুপুরীতে। সেদিন যদি ঘাতকদের গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো, তবে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোনো সিনিয়র নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটিই ছিল ঘাতকচক্রের মূল পরিকল্পনা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিলো ওই হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিলো শনিবার। সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে ওই দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ চলছিলো। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। হাজার হাজার মানুষের সমাগম ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের চতুর্দিকে। সমাবেশ শেষে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বিকেল ৫টার একটু আগে সমাবেশস্থলে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তৃতার পর শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষের মুহূর্তেই শুরু হয় নারকীয় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক আর্জেস গ্রেনেড। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশস্থল। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা মুহূর্তেই মানবঢাল রচনা করে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। ওই দিন হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কান ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জঘন্যতম ওই হামলা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায়।

মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১৯ জন: বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদ- ও এক লাখ টাকা করে অর্থদ- দেয়া হয়। তারা হলেন: সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম (সম্প্রতি মারা গেছেন), হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আব্দুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।

যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১৯ জন: বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ- দেয়া হয়। তারা হলেন: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আব্দুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, মাওলানা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন: মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আব্দুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।

এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য ও দেশকে অকার্যকর করাই ছিলো ওই হামলার উদ্দেশ্য। ভয়াবহ ওই ঘটনার পর নিরীহ জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে মূল ঘটনা ও অপরাধীদের আড়ালের অপচেষ্টা চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। শিগগিরই এ মামলার আপিল শুনানি শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More