মিতব্যয়ী হয়ে কৃচ্ছসাধন করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে

জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে দেশবাসীকে কৃচ্ছসাধনের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, প্রত্যেককে তার নিজ নিজ জায়গায় থেকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছসাধন করতে হবে। প্রত্যেককে নিজস্ব সঞ্চয় বাড়াতে হবে। মিতব্যয়ী হতে হবে। কৃচ্ছসাধন করে কিছু সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, তথা অপচয় কমাতে হবে। বিলাসদ্রব্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় মনোযোগ দিতে হবে।

বুধবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঞ্চয় বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে হবে। বিদ্যুৎ ও পানি ঢালাওভাবে ব্যবহার করবেন না। অপচয় করবেন না।

বৈশ্বিক অতিমারি করোনার আরেকটা ঢেউ এসেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। সবাইকে টিকা দিতে পেরেছি। ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শতভাগ টিকা দিয়েছি। জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় যতটুকু দেয়ার তার সবটুকুই আমরা দিতে সক্ষম হয়েছি। করোনা নতুনভাবে আবার দেখা দিয়েছে। সবাইকে বলবো, স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে হবে। এ সময় তিনি সবাইকে করোনার বুস্টার ডোজ গ্রহণেরও আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। আমদানীকৃত বিলাসবহুল দ্রব্য ক্রয় পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কথায় কথায় বিদেশে চিকিৎসা নিলে হবে না, দেশেও ভালো চিকিৎসা হয়। আজ বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ এবং করোনা মহামারি, এটা মোকাবিলা করেই আমাদের আগাতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অতিমারি আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। তবে আমরা এই ক্ষতি সামলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সরকার কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। যে কোনো ধরনের বাধা আসুক না কেন, তা মোকাবিলা করতে পারব। সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। করোনা অতিমারির সময়কালে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে, তা চলমান থাকবে বলে জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার সংকট কাটিয়ে এ পর্যন্ত ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করেছি, যার মোট আর্থিক মূল্য ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এই প্রণোদনা কার্যক্রম আমরা ৭১ দশমিক ৫৫ শাতাংশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এই প্রণোদনা চলমান থাকবে। আরেকটি সুখবর হলো, রপ্তানি খাত যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, এর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে আমরা রপ্তানি করতে পেরেছি। অতিমারি মোকাবিলা করে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্লাবে বাংলাদেশ যোগদান করেছে।

শেখ হাসিনা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রাখার জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান পুনর্নিধারণ করা হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। বিলাসবহুলসামগ্রী আমদানি যাতে কম হয়, সেজন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থবছরে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে ঘাটতি হবে, তা আমরা মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তা পর্যায়ে শতভাগ চাপিয়ে দেব না, যার ফলে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় বাড়বে। এ কারণে কার্যকর ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভর্তুকি ব্যয় সহনশীল মাত্রায় রাখা এবং আমদানির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেব।

শেখ হাসিনা বলেন, করোনা যখন কমে গেছে, তখন আমাদের আমদানি বেড়েছে। এই আমদানি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। আমরা বেশির ভাগেই ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করেছি। এগুলো স্থাপন ও চালু হলে দেশ লাভবান হবে। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এটা করতে গিয়ে হয়তো আমাদের ডলারে কিছুটা টান পড়েছে; কিন্তু সেটা এখনো আশঙ্কাজনক কোনো বিষয় নয়। মুদ্রাবিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য আমরা সব পদক্ষেপ নিয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা বারবার ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই গৌরবটা আমরা বয়ে আনতে পেরেছি। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিগত ১৩ বছরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছি। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর আমরা জোর দিয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ফলে করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় এবং গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা কমে যায়। বরং শহর থেকে মানুষ গ্রামে চলে যায়। কারণ গ্রামের অর্থনীতি ও পরিবেশ অনেক ভালো ছিল।

সবার জন্য পেনশন বিমা চালুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এ প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়েছি। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে এ আইনের অনুমোদন দিয়েছি। খুব শিগগিরই সংসদে আইনটি উঠবে। আমরা তা কার্যকর করতে পারব। তাতে যারা পেনশন পাবেন, তাদের জীবনটা সুরক্ষিত হবে। বিস্তারিত আইনে আছে।

সংসদে প্রশ্নের জবাব : প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণে দুই বছর দেরি হয়েছে। কিন্তু আমরা হতোদ্যম হইনি। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। দেশি ও বিদেশি সব ষড়যন্ত্র এবং বাধাবিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। বুধবার জাতীয় সংসদে মেরিনা জাহানের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় আরও বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং প্রত্যয়। আমরা এ সেতু করবই, সেই জেদ। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি।

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মাওয়াপ্রান্তে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তারা জাপান সরকারকে পুনরায় মানিকগঞ্জের আরিচা প্রান্তে পদ্মা সেতুর জন্য সমীক্ষা করতে বলে। দ্বিতীয়বার সমীক্ষার পর জাপান মাওয়াপ্রান্তকেই নির্দিষ্ট করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিবেদন পেশ করে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

তিনি বলেন, ঠিকাদার নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এবং আইডিবি ঋণচুক্তি স্থগিত করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে কানাডার টরেন্টোর একটি আদালতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে পুনরায় ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ না করে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

সৈয়দ আবু হোসেনের আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার অর্থনীতির চাকা সচল রেখে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় রাখার চেষ্টা করছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।

নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিজস্ব প্রযুক্তিতে স্বল্প পরিসরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ বিমান ও আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি) তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More