যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ নয় – বন্দিদের পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

যশোর প্রতিনিধি: যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ নয়; বরং কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যরে বেধড়ক মারপিটে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্ববধায়ক মাসুম বিল্লাহ, সাইকো সোস্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমানসহ ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুরে যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দু’পক্ষের বক্তব্যে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত সংঘর্ষ নয়, মারপিটেই তিনজন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে। কেন্দ্রের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে সেখানে অভ্যন্তরীণ শাস্তির রেওয়াজ আছে। সেটি করতে গিয়ে ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়টি আমরা যাচাই বাছাই করছি। কেন্দ্রের সহকারী পরিচালকসহ ৯-১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার আরও বলেন, হতাহতের ঘটনায় স্বজনদের মামলার প্রক্রিয়া চলছে। নিহতরা হলেন বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)।
এদিকে ঘটনা তদন্তে সমাজসেবা অধিদফতর দু’সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা হলেন অধিদফতরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ নুরুল বাসির ও উপপরিচালক এমএম মাহমুদুল্লাহ। গতকাল শুক্রবার অধিদফতরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
এর আগে হতাহতের ঘটনার পর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বৃহস্পতিবার গভীররাতে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেন, সংঘর্ষের কারণে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। বরং একপক্ষীয় নির্যাতনে প্রাণহানির মতো অঘটন ঘটেছে। আর এ ঘটনাটি প্রকাশ করা হয় প্রায় ৬ ঘণ্টা পর যা রহস্যজনক। তদন্তে পুরো রহস্য বের হয়ে আসবে। যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, কিভাবে এই কিশোররা হতাহত হলো তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তের পরই পুরো বিষয়টি পরিস্কার হবে।
এদিকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনায় আহত ও নিহত বন্দিরে স্বজনেরা হাসপাতাল ও কেন্দ্রে ভিড় করতে দেখা গেছে। আহত বন্দিদের স্বজনরো অভিযোগ করেছেন, সন্তানেরা গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে নিহত বন্দিদের স্বজনদের অভিযোগ, থানায় গেলে মামলা নিচ্ছে না। আবার লাশও দ্রুত দিচ্ছে না। তবে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) তৌহিদুল ইসলাম জানান, মামলার প্রস্তুতি চলছে। হতাহতদের পরিবারগুলো মামলা করলে সেগুলোও নেয়া হবে।
উল্লেখ, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘সংঘষের’ ঘটনায় তিনজন কিশোর নিহত এবং কমপক্ষে ১৪ জন আহত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে এই ঘটনা ঘটার পর সন্ধ্যায় হাসপাতালে কিশোরদের নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিষয়টি জানাজানি হয়। যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি বন্দি কিশোররা জানান, ঘটনার সূত্রপাত ৩ আগস্ট, ঈদের দু’দিন পর। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রধান প্রহরী নূর ইসলাম কয়েকজন কিশোরের চুল কেটে দিতে চান। কিন্তু কিশোররা চুল কাটতে রাজি না হওয়ায় তিনি কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন, ওই কিশোররা নেশা করে। এর প্রতিবাদে ওই দিন কয়েকজন কিশোর তাকে মারপিট করে। আহত কিশোরদের দাবি, ওই ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ১৮ জন বন্দিকে রুম থেকে বাইরে বের করে আনা হয়। এরপর বিকেল ৩টা পর্যন্ত পালাক্রমে তাদের লাঠিসোটা, রড ইত্যাদি দিয়ে বেধড়ক মারপিট করা হয়। পালাক্রমে এভাবে মারপিটের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। পরে কয়েকজন মারা গেলে সন্ধ্যার দিকে তাদের লাশ যশোর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আনসার সদস্য ও তাদের নির্দেশে কয়েকজন কিশোর ওই ১৮ জনকে বেধড়ক মারপিট করে। মারপিট নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ফেলে রাখা হয়। কয়েকজন অচেতন থাকায় তারা অজ্ঞান হয়ে গেছে মনে করলেও পরে তারা বুঝতে পারে এরা নিহত হয়েছে। এরপর সন্ধ্যায় এক এক করে তাদের লাশ হাসপাতালে এনে রাখা হয়। হাসপাতাল সূত্র জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় পর সন্ধ্যা সাতটায় রাব্বি, সুজন ও নাঈমকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. অমিয় দাস বলেন, দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি মরদেহ আসে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিটে নাইম হাসান, সাড়ে ৭টায় পারভেজ হাসান এবং রাত ৮টায় আসে রাসেলের মরদেহ। এ চিকিৎসক বলেন, ‘একজনের মাথায় ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অন্যদের শরীরের আঘাতের কোনো চিহ্ন এখনও শনাক্ত হয়নি। তিন কিশোরের মরদেহ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে বলে খবর পেয়ে সেখানে সংবাদকর্মীরা ভিড় জমান। কিন্তু তখন হাসপাতালে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কাউকে পাওয়া যায়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে উন্নয়ন কেন্দ্রে যাওয়া হলেও কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা জানান, ভেতরে পুলিশ ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ।
উল্লেখ্য, বালকদের জন্য দেশে দুটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। কিশোর অপরাধীদের জেলখানায় না পাঠিয়ে সংশোধনের জন্য এই উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। সমাজসেবা অধিদফতর এই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক। যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রায়ই অঘটন ঘটে। লাশ উদ্ধার, মারপিটের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম জেঁকে বসেছে। এর আগে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি এই তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিলো।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More