রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বিএনপি

আন্দোলনের ৫৪ দিনে পুলিশের গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার: মাঠ যার নির্বাচনে ভোট তার’ প্রবাদটি এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দলটি এবার রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এ লক্ষ্যে ডান-বাম-মধ্যপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের নামার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যুগপৎ কর্মসূচিতে নামার আগে মাঠ গরম করতে চায় দলটি। এ লক্ষ্যে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে টাকা কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। রাজধানীর কর্মসূচিতে বাধা না দিলেও জেলা পর্যায়ের কর্মসূচিতে বাধা দেয়ায় সংঘাত-সংঘর্ষের বিএনপির চার কর্মী প্রাণ হারিয়েছে। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং রাজপথে রক্তাক্ত ও বারুদের গন্ধের কারণে সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ‘চাপের’ মুখে আছে। এ অবস্থায় বিএনপি চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে আরো চাপে রাখতে। দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ের শতাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এবার নির্বাচনের নামে প্রতারিত হতে চাচ্ছেন না। রাজপথ দখলে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কেউ কেউ রাজপথের সংঘর্ষ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর গুলিতে নিহত সহকর্মীদের রক্ত ছুঁইয়ে শপথ করেছেন যত বাধা আসুন রাজপথ দখলে রাখবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন, তাদের কারো রক্ত বৃথা যেতে দিব না। অতীতে কারো রক্ত বৃথা যায়নি। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনেছি, গণতন্ত্র এনেছি; রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা রক্ষা করব এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব। লুটেরা-খুনি এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রশাসনের কেউ অতি উৎসাহ প্রকাশ করলে এর জবাব দিতে জনগণ বাধ্য হবে। নেতাকর্মীরা জেগে উঠেছে, যদি চিকন লাঠিতে না পোশায়, এরপরে প্রত্যেকের হাতে মোটা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামবে। কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। আমার ভাই মরেছে, মরতে হয় আমিও মরব। তবে, রক্তের ঋণ পরিশোধ করব। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।
সরকার ভয় পেয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুলি করছে বলে মন্তব্য করে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ১৯৬৯’এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শামসুজ্জোহা আর কেন্টমেন্টে সার্জেন্ট জহুরুল হককে মেরে ফেলা হয়েছিলো। আইয়ুব খান টিকতে পারছে? পারেনি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে গুলি চালিয়ে এরশাদ টিকতে পেরেছে? পারেনি। এই সরকারও পারবেন না।
নির্বাচনের এখনো ১৫ মাস বাকি। কিন্তু তার আগেই বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করতে চায় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। লক্ষ্য পূরণে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনমত পক্ষে নিতে জনসমির্থত নানা ইস্যু নিয়ে রাজপথে নেমেছে দলটি। সারাদেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল, মোমবাতী প্রজ্জ্বল, সভা-সমাবেশ করছে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগ, অথবা যৌথভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপির। শুধু তাই নয়, হামলার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের নামেই দেয়া হচ্ছে মামলা। তাই এখন আর কোন ছাড় না দিয়ে প্রতিরোধ এবং পাল্টা জবাব দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের। সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে- হামলায় জড়িত পুলিশ ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদেরকেও।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকেই আজকে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে আওয়ামী লীগের ভূমিকা পালন করছে, এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের লঙ্ঘন নয়; এটা আন্তর্জাতিক ক্রাইমের আওতায় পড়ে। তাদের সকলকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে কেউ রেহাই পাবে না। যারাই বাড়াবাড়ি করবে তাদের কারও রক্ষা হবে না।
বিএনপির দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জুলাই থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ৪ জন নেতা নিহত হয়েছেন। সারাদেশে অর্ধশতাধিক স্থানে হামলার ঘটনায় আহত হয়েছে ১৫শ’র অধিক নেতাকর্মী। এসব ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হয়েছে ৪০টির মতো মামলা, এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক নেতাকর্মীকে এবং আসামি করা হয়েছে ২০ হাজার জনকে। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা বলছেন, হামলা, মামলা করে বিএনপিকে আর দমিয়ে রাখা যাবে। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে নেতাকর্মীরা। তাই যেখানেই হামলা হবে সেখানে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন তারা। হামলা হলেই পাল্টা আঘাত দিয়ে জবাব দিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে সারাদেশে।
সম্প্রতি দেশে লোডশেডিং, জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। ওই কর্মসূচি পালনকালে গত ৩১ জুলাই ভোলাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আব্দুর রহিম। একই কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নূরে আলম। গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় যুবদল কর্মী মো. শাওন। আর সর্বশেষ গত বুধবার মুন্সিগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় যুবদলের ওয়ার্ড নেতা শহীদুল ইসলাম শাওনের।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেছেন ‘বিএনপি’র সব সমাবেশ প্রতিহত করা হবে।’ এর আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিএনপি’র কর্মসূচি প্রতিহতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শাসকদলের ক্যাডারদের বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালাতে লেলিয়ে দিয়েছে। ঘোষণা দিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে সরকার।
তিনি বলেন, পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, খুন-জখম ও পঙ্গু করার পর প্রধানমন্ত্রীসহ ওবায়দুল কাদের ও হাছান মাহমুদ সাহেব’রা যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে মনে হয়-এসব সহিংস ঘটনায় তারা মেতে ওঠেন আনন্দে। তবে দেশের মানুষ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। গুলি করে, হত্যা করে, হামলা করে প্রতিবাদী কণ্ঠরোধ করা যাবে না, সরকারের পতন ঠেকানো যাবে না।
গত ২২ আগস্ট থেকে দেশের উপজেলা, থানা ও পৌরসভা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে বিক্ষোভ করছে দলটি। এসব সমাবেশে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি উজ্জীবিত করে তুলেছে দলটির নেতাকর্মীদের। অন্যদিকে প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানে হামলা, সিনিয়র নেতাকর্মীদের ওপর এবং তাদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাও ভাবিয়ে তুলেছে নীতিনির্ধারণী নেতাদের। তারা মনে করেন বিএনপি এখন যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সারাদেশে সরকারবিরোধী ব্যাপক জনমতও গড়ে উঠেছে এই অবস্থায় হামলা-মামলা করে বিএনপিকে মাঠছাড়া করতে চায় সরকার। কোনভাবেই সরকারের সেই ফাঁদে পা না দিয়ে কৌশলে কর্মসূচি সফল করার নির্দেশনা ছিল তাদের।
তবে ধারাবাহিকভাবে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা, বিশেষ করে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের ওপরে হামলার পর সেই কৌশল থেকে সরে আসে বিএনপি। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ২২ আগস্ট থেকে সারাদেশের কর্মসূচিতে হামলা হয়েছে, ওই সময় স্থায়ী কমিটির মরহুম সদস্য তরিকুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীসহ অনেকে নেতার বাড়িতে হামলা হয়েছে, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ একাধিক নেতার ওপরও হামলা হয়। কিন্তু সর্বশেষ কুমিল্লায় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ও রাজধানীতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আওয়ালের ওপর হামলার পর নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন তারা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, প্রতিনিয়ত হামলা, মামলা, গুম, নির্যাতনে বিএনপি নেতাকর্মীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন তারা সিনিয়র নেতাদের ওপর হামলা করছে, মোমবাতী প্রজ্জ্বলনের মতো নিরীহ কর্মসূচিতেও হামলা চালাচ্ছে। তাই এখন আর পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। যেখানে হামলা আসবে সেখানে কোন ছাড় দেয়া হবে না। বাধা দেয়া হবে তা প্রতিরোধ করে বিএনপি এগিয়ে যাবে।
বেশিরভাগ নেতাই মনে করেন, এভাবে হামলা ও নেতাকর্মীরা মার খেতে থাকলে এক সময় তাদের মনোবলে চিড় ধরবে। তাই নেতাকর্মীদের চাঙ্গাভাব ধরে রাখতে বিনা প্রতিরোধে মার খাওয়া উচিত হবে না। হামলা হলেই পালটা আঘাতের প্রস্তুতি থাকা উচিত। কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। থাকতে হবে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। দলের এমন সিদ্ধান্তের পর থেকে প্রতিটি সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েই অংশ নিচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এসব সমাবেশে দলের নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, এবার থেকে হামলা হলে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। নেতাকর্মীদের পালটা হামলার প্রস্তুতি নিতেও নির্দেশ দেন তারা। তাদের এমন ঘোষণার পর নেতাকর্মীরাও সমাবেশে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছেন।
তারা আরও জানান, গত এক মাস ধরে সারা দেশের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন মার খেয়ে ঘরে ফিরছেন। প্রতিরোধ না করেও হয়েছেন মামলার আসামি। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে আস্থাহীনতা। যা ভবিষ্যৎ সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এমন বার্তা যেতে পারে যে বিএনপির আন্দোলনের শক্তি নেই। তাই নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখা এবং সাংগঠনিক শক্তি জানান দিতে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের বিকল্প নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ আরেকটি পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। সে কারণে আবার তারা বিরোধী দলের ওপর চড়াও হতে শুরু করেছে। গুলি, ভাঙচুর এবং হত্যা করে বিরোধী দলকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। মাঠের ভেতরে একা থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে চায়। এবার আর তা হবে না। আমরা এবার কোনোমতেই পরাজিত হব না। কারণ, এবার বিজয় লাভ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More