সারাদেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন খুলনা : দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ

বাস-লঞ্চ বন্ধ : সমাবেশস্থলে হেঁটে পৌঁছাচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা

স্টাফ রিপোর্টার:

খুলনায় আজ বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ এবং দলের সহযোগী সংগঠনগুলো। এদিকে গতকাল থেকেই মালিক পক্ষ লঞ্চ ও পরিবহন ধর্মঘট শুরু করায় সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিপাকে পড়েছেন।

এ অবস্থায় পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে দুপুর থেকেই বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা খুলনায় আসতে শুরু করেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি এবং জ্বালানি তেল, চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিএনপির নেতা-কর্মী হত্যা, হামলা ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ খুলনায় বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। গণসমাবেশ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা খুলনায় অবস্থান করছেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে গতকাল দুপুরে কেডি ঘোষ রোডে বিএনপির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকার সারা দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বাস চলাচল ও লঞ্চ ট্রলার পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপরও খুলনায় গণসমাবেশ স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনস্রোতে পরিণত হবে। তিনি কর্মসূচি সফল করতে পুলিশসহ সংশি¬ষ্টদের উসকানিমূলক আচরণ না করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। যে কোনো পরিস্থিতিতে বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরু হয়ে চলবে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। আমাদের দলের নেতা-কর্মী যতই আঘাতপ্রাপ্ত হোক না কেন, যে জনস্রোত দেখা দিয়েছে, যে জনউৎসাহ দেখা দিয়েছে তাকে কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, বিএনপি নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জয়ন্ত কুমার কুন্ডু উপস্থিত ছিলেন।

খুলনায় বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে বিচ্ছিন্ন খুলনা। সারাদেশের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এমনকি জেলার মধ্যেও চলেনি কোনো যাত্রীবাহী বাস ও লঞ্চ। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসা নিতে আসা অসুস্থ রোগী ও তাদের স্বজনরা। নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা পড়েছেন সীমাহীন ভোগান্তিতে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অসুস্থ রোগীদের অনেকেই চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এমনি চাকরির পরীক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এতে চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন তারা। অনেকেই বাস-টার্মিনালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কোনো উপায় না পেয়ে ফিরে গেছেন। কেউ কেউ গণপরিবহন না পেয়ে বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। তাতেও স্বস্তি মেলেনি। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছেন। জেলার সঙ্গে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সমাবেশে যোগ দিতে একদিন আগে থেকেই খুলনার মুখে যাত্রা শুরু করেছেন বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। এতে তারাও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। হয়েছেন নানা বাধার সম্মুখীন। ব্যক্তিগত গাড়ি, ভ্যান, রিকশা, মোটরসাইকেলসহ যে যেভাবে পারছেন খুলনা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পৌঁছেছেন। জেলার প্রবেশমুখে বাধার মুখে অনেকেই ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে জনস্রোত ঠেকাতে সরকার আগেভাগেই গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি জেলার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী যেসব এলাকায় লঞ্চ চলাচল করতো সেগুলোও হঠাৎ ধর্মঘট ডেকেছে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দেয়ার জন্য আসতে চাইলেও বাস কিংবা গণপরিবহন পাচ্ছেন না। তাই অনেকেই পায়ে হেঁটে খুলনায় ছুটছেন। সড়কে-মহাসড়কে মানুষের লাইন। উদ্দেশ্য খুলনার মহাসমাবেশ।

বিএনপি’র নেতাকর্মীরা নানা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সমাবেশস্থলে আসছে। অনেকেই পৌঁছে গেছেন। শেষ রাতের মধ্যে সমাবেশের মঞ্চ প্রস্তুত করা হবে। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে খুলনার অভন্ত্যরীণ রুটের বাস বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল থেকে ২দিন বাস বন্ধ থাকবে এমন ঘোষণায় ওই রাতেই আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ঢাকা কিংবা বিভিন্ন রুটের বাস খুলনার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে প্রবেশ করলেও খুলনায় ঢোকেনি। এমনকি খুলনা থেকেও কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।

গতকাল সকাল থেকেই খুলনা বাস-টার্মিনালে ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। টার্মিনালে সারি সারি বাস বন্ধ করে রেখেছেন মালিক শ্রমিকরা। বাস শ্রমিকরা কেউ অলস সময় কাটাচ্ছেন। আবার অনেকেই খেলাধুলায় মেতে উঠেছেন। যাত্রীরা নানা আকুতি মিনতিতেও মন গলেনি বাস শ্রমিকদের। তবে বাস শ্রমিকরা বলছেন, আমরা বাস চালাতে চাচ্ছি। ওপর থেকে বাস চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। বাস ২দিন বন্ধ থাকলে আমাদেরও পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। আমরা চাই হুটহাট করে যেন বাস চলাচল বন্ধ না হয়।

সকাল ১০টায় সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে কথা হয় জাহানারা নামে এক যাত্রীর সঙ্গে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার বড়বোন ঝিনাইদহে অসুস্থ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাকে দেখতে যাবো। বাস টার্মিনালে এসে দেখি বাস বন্ধ। এখন যাব কি করে? অন্তরা বনি নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাকপ্রতিবন্ধী পিসি (ফুফু) কে নিয়ে ঢাকায় যাবো। বাস বন্ধ থাকায় যেতে পারছি না। বাস না পেয়ে এখন ফিরে যাচ্ছি। শুনছি আগামীকালও চলবে না। বাস বন্ধ থাকায় খুলনা জিরো পয়েন্ট থেকে মানুষকে কয়েক ধাপে ভেঙে ভেঙে অটো, সিএনজি, রিকশা ও মোটরবাইকে করে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। এতে গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া।

অন্যদিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ ২২ অক্টোবর খুলনা বিএনপি’র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সমাবেশ শুরু হওয়ার একদিন আগে থেকেই পায়ে হেঁটে খুলনায় পৌঁছান অনেকেই। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতেই সরকার গণপরিবহন বন্ধ রাখছেন। গতকাল সকাল থেকে বিভাগের পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে পায়ে হেঁটেই বিএনপি নেতাকর্মীরা দলে দলে ভাগ হয়ে খুলনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছেন। বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মানুষ বিভিন্ন জেলা থেকে পায়ে হেঁটে খুলনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছেন। সরকারদলীয় লোকজন বিভিন্ন পয়েন্টে বাধা দিচ্ছে। মানুষ বিকল্প উপায়ে বিভিন্ন পন্থায় খুলনার সমাবেশে যোগ দেবেন।

খুলনার পার্শ্ববর্তী জেলা যশোর থেকে খুলনার প্রবেশ মুখে বাধা দেয়ার অভিযোগ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দলটির নেতাকর্মীদের বাধার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও একাধিক পয়েন্টে বাধা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারদলীয় লোকজন। এতে নিম্নআয়ের মানুষও কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেনি। এদিকে গতকাল রাত পর্যন্ত যশোর থেকে পথে পথে বাধা অতিক্রম করে ও নানা অজুহাতে বিএনপি নেতারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে খুলনায় পৌঁছান। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় লোকজনের বাধার মুখে পড়ে যশোরে ফিরে গেছেন। কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে একাধিক রুট বদল করে খুলনায় আসেন।

যশোর থেকে আসা নেতারা বলছেন-দলের নির্দেশ ছিল যেকোনো উপায়ে খুলনা সমাবেশস্থলে পৌঁছুতে হবে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও দলের নির্দেশনা মানতে একাধিক রুট পরিবতন ও রাস্তা ভেঙে ভেঙে খুলনা পৌঁছায়। অনেকে কোনো প্রকার গাড়ি না পেয়ে দলবদ্ধ হয়ে পায়ে হেঁটে রাতেই সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন।

যশোর থেকে আসা সাদ্দাম হোসেন বলেন, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সিএনজি, মোটরসাইকেল ও রিকশায় করে পথ ভেঙে ভেঙে খুলনায় এসেছি। তবে কোনো হোটেলে বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে উঠতে দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, সরকার বিএনপি’র খুলনা বিভাগীয় সমাবেশ বানচাল করার পাঁয়তারা করেছে। নেতাকর্মীরা যাতে সমাবেশস্থলে আসতে না পাওে সেজন্য বাস বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার বিএনপি’র বিরুদ্ধে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে কোনো বাধাই বিএনপি’র সমাবেশ ঠেকাতে পারবে না। মানুষ ভাসতে ভাসতে সমাবেশে পৌঁছে যাবে। রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল যে যা পাচ্ছে তাকেই বাহন হিসেবে চলে আসবে।

আল-আমিন নামের যশোর বিএনপি’র এক নেতা বলেন, বাস বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে পায়ে হেঁটে খুলনা পৌঁছাই। পথে আমাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছি। তবে দীর্ঘপথ আসতে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

এদিকে বাস ধর্মঘটের পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যাত্রীবাহী লঞ্চও। গতকাল সকাল থেকে দাকোপ, কয়রা, সাতক্ষীরা এলাকায় সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এতে ভোগান্তিতে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। যাতায়াতের সকল মাধ্যম বন্ধ থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘাট থেকে ফিরে গেছেন তারা। তবে বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করেছে এমনটা মানতে রাজি নয় বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন খুলনা জেলা শাখার নেতারা। তারা বলছেন, লঞ্চ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকরা। প্রতিদিন খুলনা থেকে পাঁচটি লঞ্চ দক্ষিণ দিকে যায়। শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর খুলনা থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে না। তবে মালবাহীসহ অন্যান্য লঞ্চ ও নৌযান চলাচল করছে। কয়রা থেকে খুলনায় আসা দিলীপ চন্দ দে বলেন, গতকাল সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজকর্মী নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিকল্প উপায়ে ভেঙে ভেঙে খুলনা পৌঁছুতে আমার পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে যায়। এতে আমি আর্থিক ও মানসিকভাকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। বিএনপি’র সমাবেশ শনিবার একদিন আগে পরীক্ষা। বাস লঞ্চ যদি বন্ধ করতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে যাতায়াত করবে। পরীক্ষা কেন পিছিয়ে দেয়া হলো না। এখন আমার যে ক্ষতি হলো তার দ্বায়ভার কে নিবে। একটা চাকরি আমার খুব প্রয়োজন। আমার বাড়িতে অসুস্থ বাবা মা আছে। তারা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় নড়াইল থেকে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা নদীপথে ট্রলারযোগে খুলনায় আসছেন। গতকাল রাতেই নড়াইলের ৩ উপজেলা থেকে খুলনাগামী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাই সামবেশে যোগ দিতে বিকল্প পথে খুলনায় আসছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এরমধ্যে অনেকে ট্রলারে, কেউ ইজিবাইক বা মোটরসাইকেলে ভেঙে ভেঙে খুলনায় আসেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিএনপি’র নেতারা জানান, নড়াইল থেকে নদীপথে কয়েক হাজার নেতাকর্মী খুলনায় পৌঁছেছেন। নড়াইল জেলা বিএনপি নিতা টিপু সুলতান বলেন, অনেক নেতাকর্মী আগেই খুলনায় অবস্থান নিয়েছেন।

গতকাল সকাল থেকেই খুলনা জেলা বিএনপি অফিসের সামনে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আরও বাড়তে থাকে। পার্টি অফিসের কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন তারা। বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে আসা মিরাজ নামের একজন বলেন, তারা গতকাল ভোর রাতে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। পথে আওয়ামী লীগের লোকজন বাধা দিয়েছেন। তাদের কয়েকজন হামলার শিকার হয়েছেন। মোরেলগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকায় তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করেন যুবলীগ-ছাত্রলীগের লোকজন। পরে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হয়। তবে সমাবেশে অংশ নিতে পথ পরিবর্তন করে মোংলা হয়ে খুলনায় আসেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সদর থানার উত্তর পাশে মহিলা দলের নেতা কর্মীরা, পার্টির অফিসের নিকটস্থ মোড়ে মেহেরপুর থেকে আসা নেতা-কর্মীরা, অফিসের নিচে চুয়াডাঙ্গা, যশোরসহ খুলনা জেলার নেতারা অপেক্ষা করছেন। এ সময় তারা সরকার বিরোধী নানান ধরণের সেøাগাননও দেন। দূরবর্তী জেলার নেতা-কর্মীরা বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকায় ছোট ছোট পরিবহনে তারা খুলনায় এসেছেন শনিবারের খুলনার বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করতে। নেতা-কর্মীরা জানান, কোথাও থাকার জায়গা নেই। হোটেলে পর্যাপ্ত খাবার নেই। আমরা বিএনপি অফিসের সামনেই সারারাত অবস্থান করব। অনেকে সমাবেশের স্টেজের স্থানেও থাকবে। আমরা দূর-দূরান্ত থেকে সমাবেশকে সফল করতে এসেছেন অনেকে। তারা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিভিন্ন সেøাগান দিচ্ছেন।

জানা যায়, সাতক্ষীরা, নড়াইল, খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা কয়রা থেকে ট্রলারযোগে নেতাকর্মীরা খুলনায় এসে পৌঁছান। কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রেনে করে অসংখ্য নেতাকর্মী খুলনায় পৌছেছেন। তাদের অনেকেই হাতে পানির বোতল ও ঘাড়ে ব্যাগে কাপড়চোপড় নিয়ে সমাবেশে যোগ দিতে এসেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এবং জ্বালানি তেল, চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিএনপির নেতাকর্মী হত্যা, হামলা ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে খুলনায় বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে মেহেরপুর থেকে খুলনাগামী সব পরিবহন বন্ধ রেখেছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সমিতিগুলো। এতে খুলনাগামী সাধারণ যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। অনেকে যেতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন। কেউ কেউ ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে খুলনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। পৌর শহরের বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আবু রায়হান বলেন, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করে পরিবহন থেকে জানানো হয়, খুলনাগামী আর এ পরিবহন যশোরে আজ পর্যন্ত যেতে দিয়েছে। তবে আগামীকাল থেকে আর যাবে না। আগের দিন টিকিট কেটেছিলাম। সেই টিকিট ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ আর এ পরিবহনের টিকিট মাস্টার শরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে অবরোধ ডাকা হয়েছে। সে কারণে সরাসরি খুলনায় বাস যেতে পারছে না। পরিবহনশ্রমিক মোশারফ হোসেন বলেন, খুলনায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে বাস ও মাইক্রোবাস বন্ধ রাখা হয়েছে। যাতে করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যেতে না পারেন। এসব করে জনগণকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া কিছু লাভ হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাইক্রোবাসচালক বলেন, মাইক্রোবাসের মালিকদের আগে থেকে আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা নিষেধ করেছেন খুলনায় কোনো প্রকারের ভাড়ায় যেতে। জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা কয়েক দফা যোগাযোগ করেন মাইক্রোবাস ভাড়া নিতে। কিন্তু নিষেধ থাকায় ভাড়ায় যাওয়া হয়নি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ও রাতে মাইক্রোস্ট্যান্ড থেকে ২২টি মাইক্রোবাস ছেড়ে গেছে যাত্রী নিয়ে। পৌর শহরের কলেজ মোড় এলাকায় আজ সকাল থেকে পুলিশ কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। মেহেরপুর বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘খুলনা পরিবহন সমিতির নির্দেশে খুলনাগামী বাস বন্ধ রয়েছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সব কিছুতো বলা যায় না। বাকিটা বুঝে নিয়েন।’

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল থেকে কুষ্টিয়া বাস টার্মিনাল থেকে খুলনাগামী কোন যাত্রীবাহী বাস চলাচল না করার ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। হঠাৎ করে এমন বাস চলাচল বন্ধের ফলে অনেকেই কাউন্টারে এসে ফিরে গেছেন। এছাড়া বিকল্প পথ হিসাবে রেল ও প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে খুলনায় যাচ্ছেন অনেক যাত্রীরা। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া-খুলনা রুটে এ বাস চলাচল বন্ধ বলে নিশ্চিত করেন কুষ্টিয়া জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহাবুল ইসলাম। তিনি জানান, খুলনায় জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি ও খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে শুক্র-শনিবার বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কারণে খুলনা রুটে বাস চলাচল বন্ধ। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও মহাসড়কে নসিমন, করিমন, মাহিন্দ্র, অতুল, ইজিবাইকসহ তিন চাকার অবৈধ যানবাহন চলাচলের প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া বাস কাউন্টারে এসে খুলনায় উদ্যোশ্যে যাওয়া যাত্রীরা অনেকেই ফিরে গেছেন। তানিয়া খাতুন নামের এক যাত্রী জানান, হুট করে এমন বাস বন্ধের ফেলে বাস টার্মিনালে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। কদিন পরে পরেই বাস মালিক সমিতি বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে এমন ধর্মঘট করার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তী হয়। রফিকুল ইসলাম নামের আরেক যাত্রী জানান, বাস বন্ধ থাকায় ট্রেনে যেতে হবে। তাই টার্মিনাল থেকে স্টেশনে যাচ্ছি ট্রেনে যাওয়ার জন্য। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি খুলনাগামী শিক্ষার্থী ও চাকরির প্রত্যাশিরাও ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। শুক্রবার কুষ্টিয়া বাস টার্মিনাল থেকে খুলনা গামী কোন বাস চলাচল করেনি। খুলনাগামী অধিকাংশ পরিবহনের কাউন্টার বন্ধ। কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ সোহরাব উদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘কেন্দ্র ঘোষিত বিএনপির খুলনা মহানগরের সোনালী ব্যাংক চত্বরে খুলনা বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। যাতে আমাদের নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে পৌঁছুতে না পারে এজন্য এমন বাস বন্ধ রয়েছে। এটা সরকারে একটা চক্রান্ত। এছাড়া রাতে আমাদের নেতাকর্মীদের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে হয়রানিসহ কয়েকজনকে আটক করেছে। তারপরেও আমরা গণসমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য যাচ্ছি।’ তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘সরকার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।’ জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদী রুমী জানান, ‘খুলনা বিভাগীয় গণসমাবেশ অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের নেতাকর্মীরা বাসের পরিবর্তে ট্রেন, প্রাইভেট কার, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ যেকোনো যানবাহনে তারা খুলনার দিকে যাচ্ছে। সরকার বাস বন্ধ রেখে আমাদের নেতাকর্মীদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More