স্বাধীনতা দিবসের বিবৃতিতেও কূটনীতি রাজনীতি সরব

বাংলাদেশের নিজম্ব স্বার্থ ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে বিশেষজ্ঞদের তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ নিয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাছিল এবং এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার ইঙ্গিত অব্যাহত রেখেছে প্রভাবশালী দেশগুলো। কয়েক মাস ধরে কূটনীতিকদের নানারকম পালটাপালটি বিবৃতি এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কূটনৈতিক পাড়ায় ঘন ঘন দেখা সাক্ষাতের ঘটনা বিষয়টিকে আরও গুরুত্ববহ করে তুলেছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবার বাংলাদেশের ৫২তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের বিবৃতি ভিন্নমাত্রা জুগিয়েছে। প্রত্যেক দেশের বিবৃতিতে বাংলাদেশ নিয়ে দেশগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য ও আশাবাদ একেবারে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। এতটা খোলামেলা অভিমত এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতি আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। বহু আগে থেকে আমরা যে যার সুবিধামতো বিদেশিদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করার কালচারে অভ্যস্ত। যে কারণে যেসব কূটনীতিকের যে ধরনের আচরণ ও বক্তব্য-বিবৃতি দেয়ার কথা নয় তা তারা অবলীলায় দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো বক্তব্য দিচ্ছেন। একটা স্বাধীন দেশে এসব প্রত্যাশিত নয়। বরং নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করার পথ তৈরি করতে হবে। তা না হলে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানারকম বিদেশি হস্তক্ষেপ বাড়তেই থাকবে।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির সোমবার বলেন, সবাই সবার কথা বলবে। বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে নিজস্ব মূল্যবোধের আলোকে। প্রভাবশালী বিদেশিদের দুই ভাগে দেখা যায়। একটা পক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পক্ষে। অন্য একটি পক্ষ অথরিটারিয়ান পন্থায় অগ্রসর হওয়ার পক্ষে। ফলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে অগ্রসর হবো।

কূটনীতিকদের সঙ্গে দলগুলোর বৈঠক প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক নেতারা গিয়ে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করছেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এসব হয় না। রাষ্ট্রদূতরাও অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে এটা নতুন কিছু নয়। ৩০ বছর ধরে এসব চলছে। আমরা এই পথ সৃষ্টি করে দিয়েছি। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতরা যেপথে চলাচল করেন সেপথে সামনে-পেছনে পুলিশের গাড়ি থাকে। মেগা মাইক্রোফোনে পুলিশ রাস্তায় আওয়াজ করে। নিরাপত্তা মানে তো এসব নয়।

এদিকে সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে গুলশান-বারিধারার কূটনীতিপাড়া বেশ সরব। কূটনীতিপাড়ায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে দুটি বৈঠক। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলও ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ দুটি বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদেশিদের কাছে নালিশ করেছে। যদিও দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশিদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলা পছন্দ করে না বলে দাবি করে আসছেন। তাদের এমন অভিমতকে নিজেরাই অমান্য করে বিদেশিদের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। যা একেবারে স্ববিরোধী অবস্থান। বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আওয়ামী লীগের নেতারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচন হবে সংবিধানের আওতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারই ভোটের সময়ে ক্ষমতায় থাকবে। অপরদিকে বিএনপির সঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনারের বৈঠকে ভারতের তরফে মূল বক্তব্যই ছিল, পাকিস্তানপন্থি জামায়াতে ইসলামীকে যেন বিএনপি তাদের নির্বাচনি মোর্চায় না নেয়। জামায়াতের কাউকে যেন বিএনপি মনোনয়ন না দেয়। যদিও কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করে বলেছেন, ভারত শেখ হাসিনার পাশে থাকবে।

কূটনীতিপাড়ায় একাধিক বৈঠকে দলগুলো যেমন তাদের প্রত্যাশার কথা বলছেন, তেমনি প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করছেন। যার কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেছে এবার স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের বার্তায় দেশগুলো বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি কিছু প্রত্যাশার কথাও বলেছেন। প্রশংসা করার আড়ালে কৌশলে যে যার স্বার্থ ও বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার বার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে তার দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশকে চীনবিরোধী মোর্চা ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস)-এ বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।

যদিও নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেননি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তবে শি জিনপিং তার প্রতিষ্ঠিত বেল্ট অ্যান্ড রোডে (বিআরআই) বাংলাদেশকে পেয়ে আপ্লুত। তিনি মনে করেন, এটি বাংলাদেশের উন্নতির সোপান।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে দুই দেশের গঠনমূলক সহযোগিতার প্রতি জোর দেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ঢাকাকে তার প্রতিবেশী প্রথম নীতির উল্লেখ করেছেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে দেশগুলোর স্বার্থ আলাদা। বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থানও ভিন্নতর। তবে বিদেশিদের প্রত্যাশা পূরণে নয়, বাংলাদেশকে নিজস্ব মূল্যবোধের আলোকে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রসর হতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নত দেখতে চাই। সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, আমাদের আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করতে হবে। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক জনগণের অংশগ্রহণমূলক শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যা করার তার সবই করতে হবে। আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে সবার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের উচিত হবে মৌলিক মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করা। যেখানে বাংলাদেশের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন থাকতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, সামনে যত দিন আগাবে ততই প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট হবে। তবে তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ থাকে। সেক্ষেত্রে কেউ সফল হয়, কেউ হয় না। কেউ আবার হস্তক্ষেপ না করে ভিন্নভাবে অগ্রসর হয়। এগুলো তাদের কৌশল।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More