স্বামীকে আটকে রেখে এমসি কলেজ হোস্টেলে নববধূকে গণধর্ষণ

উত্তাল সিলেট : ছাত্রলীগের ছয় কর্মীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা : ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি

স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ হোস্টেলে শুক্রবার রাতে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে এখন উত্তাল সিলেট। গতকাল শনিবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে ছাত্রলীগও। ধর্ষণের ঘটনায় সিলেট বিভাগসহ সর্বত্র তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেছেন, অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। গতকাল শনিবার দুপুরে এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ধর্ষকদের গ্রেফাতারের দাবিতে কলেজ গেটে গাড়ির টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সিলেট-তামাবিল সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে একই দাবিতে চৌহাট্টায় ওই সময় আরেকটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিকেলে কোর্ট পয়েন্টে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন মানববন্ধন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সুধীমহল তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, কতিপয় ধর্ষক, সন্ত্রাসী ও দুষ্ট লোকের জন্য রাজনীতি আজ কলুষিত। তাদের জন্য ভালো লোক রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। ফলে প্রকারান্তরে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। তারা দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা এবং ধর্ষকদের পৃষ্টপোষকদেরও মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানান। শুক্রবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির এক তরুণী স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসেন। এ সময় ছাত্রলীগের কর্মী এম সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনির নেতৃত্বে স্বামী ও স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা। পরে রাত ১০টায় খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ধর্ষিতা ও তার স্বামীকে উদ্ধার করে। ধর্ষিতা বর্তমানে ওসামানী হাসপাতালে ওসিসিতে চিকিৎসাধীন। ওই সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা তরুণী ও স্বামীর প্রাইভেট কারও ছিনিয়ে নেয়। পুলিশ প্রাইভেট কার উদ্ধার করেছে। ধর্ষকদের একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে পুলিশ।

ছাত্রলীগের ছয় কর্মীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা : ঘটনাটি রাতেই সিলেটে চাউর হয়। ঘটনার পর রাতভর অভিযান চালালেও কোনো অভিযুক্তকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ধর্ষণের ঘটনাটি স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা প্রথমে চাপা দিতে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে এবং পুলিশ জেনে গেলে তা আর সম্ভব হয়নি। তবে সময়ক্ষেপণের কারণে অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনায় শনিবার সকালে ৯ জনকে আসামি করে সিলেট শাহপরান থানায় ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। পুলিশও গণধর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি ছাত্রলীগের ক্যাডার এম সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে পৃথক আরেকটি মামলা করেছে। এর আগে ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সাইফুরের রুম থেকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রচুর পরিমাণে দেশীয় ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে বলে জানিয়েছে। ধর্ষিতার স্বামীর দায়েরকৃত মামলায় ছয় জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো তিন জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে আসামিরা হলেন এম সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান। এরা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসামিদের মধ্যে তারেক ও রবিউল বহিরাগত, অন্যরা এমসি কলেজের ছাত্র। চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর ইন্দ্রানীল ভট্টাচার্য্য জানান, আসামিদের ধরতে মাঠে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কেউ গ্রেফতার হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সিলেটের আহ্বায়ক ফারুক মাহমুদ চৌদুরী বলেন, এর আগেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রবাস পুড়িয়েছে। টিলাগড় এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একের পর এক হত্যাকা- চালিয়েছে। কিন্তু এসবের একটিরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি, আসামিরা চিহ্নিত হয়নি। ফলে তারা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই আজকের এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার শাস্তি না হলে আমরা সভ্য সমাজে মুখ দেখাবো কেমনে?

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, আসামি ধরতে পুলিশ তৎপর। এরই মধ্যে ভিকটিমের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।

ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সিলেট আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বলেন, অপরাধী যে দলেরই হোক, শাস্তি পেতেই হবে। তারা বলেন, একজন গৃহবধূকে ঐহিত্যবাহী বিদ্যাপীঠের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করে তারা কলেজকে কলুষিত করেছে, যার কারণে তাদের কোনো ছাড় নেই। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের দাবি একটাই, আসামিদের গ্রেফতার। এমন অপরাধীদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন তাদের বিষয়েও কেন্দ্রকে অবহিত করবো। তাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।

সবাইকে হল ছাড়ার নির্দেশ : ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় শনিবার দুপুর ১২টার মধ্যে ছাত্রবাস ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজ অধ্যক্ষ দুপুরে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জরুরি বৈঠকে বসেছেন। করোনার সময়ে হোস্টেল বন্ধ থাকলেও ছাত্ররা কীভাবে ছাত্রাবাসে থাকছে এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিছু শিক্ষার্থী টিউশনি করানোর কারণে ছাত্রাবাসে থাকছেন। তাদেরকেও হল ছাড়তে হবে।

কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ বলেন, ‘বন্ধ ক্যাম্পাসে এ ধরনের ঘটনায় আমি লজ্জিত। আমি অসহায়। আমার মাথা নিচু হয়ে গেছে।

এদিকে গণধর্ষণের ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুই নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবার কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ উদ্দিন এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ আচার্য্য ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদের মধ্যে শেষের দুজন হোস্টেল সুপারের দায়িত্বে রয়েছেন। অধ্যক্ষ আরো জানান, সার্বিক বিষয় তদন্তের জন্য তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সাত কার্য দিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More