হু-হু করে বাড়ছে দাম : নিয়ন্ত্রণহীন ভোজ্য তেলের বাজার

নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অ্যাকশনে নামছে প্রশাসন

স্টাফ রিপোর্টার: সয়াবিন তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা এবং আসন্ন রমজান ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। তাদের অতিমুনাফার লোভে দাম বাড়ছে হু-হু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে রিফাইনারি কোম্পানিগুলো হঠাৎ করেই তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ডিলার ও পাইকারিতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েছে। বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ৫ লিটার তেলের বোতল বাজার থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। রোজার আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দাম নেওয়া ঠেকাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশনে’ নামার ঘোষণা দিয়েছেন টিপু মুনশি। সরবরাহ সংকটের কারণে বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। দুপুরের দিকে প্রতি লিটার ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় পাওয়া যেত। সন্ধ্যায় তা বেড়ে ১৯০ থেকে ২০৫ টাকায় উঠেছে। এছাড়া অনেক দোকানে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে এগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছে বাড়তি দামে বিক্রির আশায়। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে কোম্পানিগুলো একদিকে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়তি দামেও তারা সয়াবিন পাচ্ছেন না। ফলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে কয়েকদিন ধরে সয়াবিন তেলের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ও পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে ঊর্ধ্বমুখী। অথচ এসব বাজারে তেলের সরবরাহে কোনো কমতি নেই। এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তারা প্রতি টন ১ হাজার ৭৩০ ডলারে কিনছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনার মূল্যের পার্থক্য হচ্ছে ২৪৮ ডলার।

বুধবার সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানালেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকারের এজেন্সি, জেলা প্রশাসক ও বাজার মনিটরিং টিমগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।  আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে পণ্যের মূল্য, আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বৈঠক করেন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা, এজেন্সি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আগামী ৩১ মে থেকে সয়াবিন এবং ৩১ ডিসেম্বর পামঅয়েল তেল বাজারে খোলা বিক্রি নিষিদ্ধ। এটি বাস্তবায়নে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি আজকে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, টিসিবি, প্রতিযোগিতা কমিশন, সরকারের এজেন্সিগুলোকে ডেকেছি। ব্যবসায়ীরা যাতে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য মেনটেইন হয় এবং কেউ যাতে পণ্যের বাজারে কোনো খারাপ প্র্যাকটিস না করে এ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমি প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছি। ভোগ্যপণ্যের বাজারে কোনো কালো হাতের প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া হবে না। কোনোভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিচরণ করতে দেওয়া হবে না। এ জন্য যতটুকু যেত হয় যাব এবং যত শক্ত হওয়া দরকার সেটি করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীর কৌশল ধরা পড়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য পরিস্থিতি দেখে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন পণ্যের মূল্য ও মুনাফার হার বের করে। কিন্তু ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য গড়মিল পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বেশি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জন্য। পাশাপাশি সরকারের এজেন্সি ডিজিএফআই, এনএসআইকে বলা হয়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। সরকার এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেবে, কিন্তু এর মানে তা নয়; ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো সবকিছু করবে। তিনি আরও বলেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ও দেশি মূল্য যৌক্তিকতা তুলে প্রতি মাসে তথ্য প্রকাশ করা হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে। এতে কোন পণ্যের দাম বেশি সহজে সবাই ধরতে পারবে।

গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আপনারা বাজারে এবং সাধারণ মানুষকে বলেন- সরকার নিত্যপণ্যের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে আছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আগামী এক মাস পর রোজা শুরু হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, টিসিবির যে সক্ষমতা আছে তার চেয়ে চারগুণ বেশি সক্ষমতা নিয়ে বাজারে আসছে। সরকার কার্ড বিতরণ করে টিসিবির মাধ্যমে সারা দেশে এক কোটি মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে চিনি, ভোজ্যতেল, মশুরডাল, পেঁয়াজ, ছোলা বিক্রি করবে। এতে করে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন। আমদানিকৃত পণ্য যাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যৌক্তিক মূলে বিক্রয় হয়, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ভোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। মানুষকে সতর্ক-সচেতন করতে দেশের প্রচার মাধ্যমকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে আজকে দাম বাড়লে আজই ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে কার্যকর করছে, সরকারের কাছে একটি চিঠি দিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে, সেটি কার্যকর করা না হলে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই কার্যকর করেন। দেশ কি ব্যবসায়ীরা চালাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এসব কাজ ব্যবসায়ীরা করছে না, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা করছে। সরকার অবশ্য বিষয়টি দেখছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।

অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে অভিযান শুরু করবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, পৃথকভাবে এবং প্রয়োজনে যৌথভাবে সব ধরনের অভিযান বাজারে চালানো হবে।

জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়ারিন তেলের দাম গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ১০০ ডলার। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে বেড়েছে জাহাজ ভাড়া। বাড়তি দাম ও বেশি জাহাজ ভাড়ার কারণে অনেকেই এখন নতুন এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।

আমদানি ও এলসি কমেছে : ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা ৫৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং আমদানি ৩০ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে পরিশোধিত তেল আমদানির এলসি খোলা ১০৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং আমদানি ৫৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে অপরিশোধিত তেল আমদানির এলসি খোলা ও আমদানি দুটোই কমেছে। অপরিশোধিত তেল আমদানি করে দেশীয় কোম্পানিগুলো পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে। চাহিদার বড় অংশই দেশীয় কোম্পানিগুলো থেকে মেটানো হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। এ কারণে আমদানির হার আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু অপরিশোধিত তেলের আমদানির এলসি খোলা কমেছে ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটারে খোলা সয়াবিনের দাম ৭ টাকা এবং বোতলজাত তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এর পর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে তারা ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রতি লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়ানের প্রস্তাব করে। বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়।

খুচরা বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার সকালে ও রাতের ব্যবধানে তেলের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে গেছে। সকালে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৭৫ টাকা। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা। রাতে তা বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। এছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটারের সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৮৩০-৮৪০ টাকা। প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকা।

তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি লিটার তেলে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে সময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা, বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন ১৬৮ টাকা ও বোতলজাত পাঁচ লিটারের সয়াবিন ৭৯৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া খোলা পাম অয়েলের দর নির্ধারণ করা হয় ১৩৩ টাকা। সেক্ষেত্রে সরকারি দর অনুযায়ী বাজারে বুধবার দুপুরে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ৩২ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন সরকারের নির্ধারিত দামের থেকে ১২ টাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা বেশি দরে। সন্ধ্যার এ ব্যবধান আরও বেড়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More