১৩ বছর কুর্কীতির পর র‌্যাবের জালে সাহেদ : বোরকা পরে পালানোর চেষ্টা ব্যার্থ

স্টাফ রিপোর্টার: একবার গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন হাজতবাসের পরই মিলেছিলো মুক্তি। এরপর চাকরি দেয়া, ব্যবসা, ঋণ, পণ্য সরবরাহ, পণ্য কেনাসহ বিভিন্ন কাজে জালিয়াতি করে হয়ে ওঠেন কোটিপতি ব্যবসায়ী। হাসপাতালসহ কম্পানি ও সংবাদপত্রের মালিক হয়ে টেলিভিশন টক শো করে বনে যান মিডিয়া ব্যক্তিত্বও। শত অপকর্ম আড়াল করে রাজনৈতিক দলের নেতাও সাজেন। এরপর করোনার সংকটে মানুষের জীবন নিয়ে ভয়ংকর প্রতারণা করেন।
র‌্যাবের অভিযানে অবশেষে বহুরূপী এই প্রতারকের ১৩ বছরের কুকীতির ইতিহাস চাউর হয় দেশবাসীর সামনে। তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা নিয়ে সারা দেশে চলছিল গুঞ্জন। ৯ দিন পরে সেই জালিয়াত মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম গ্রেফতার হয়েছেন। র‌্যাব জানিয়েছে, গতকাল বুধবার ভোর ৫টার দিকে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দাদল র‌্যাব-৬-এর সহায়তায় সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা থেকে গ্রেফতার করেছে সাহেদকে। উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের শাখরা সীমান্তের কোমরপুর থেকে তাকে একটি পিস্তলসহ ধরার সময় র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তিও হয়। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, আগের রাতে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে সাহেদের রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে সাতক্ষীরায় অভিযান চালানো হয়। ‘চতুর, ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু’ সাহেদ ঢাকা থেকে নরসিংদীর মাদবদী, কক্সবাজারের মহেশখালী, কুমিল্লা ও ঢাকা হয়ে সাতক্ষীরায় আত্মগোপন করেন। প্রশাসনের চোখ এড়াতে সাহেদ কখনো ভাড়া গাড়ি, কখনো ট্রাক, কখনো হেঁটে বিভিন্ন স্থানে গেছেন। গ্রেফতার এড়াতে চুলে কলপ দিয়ে, গোঁফ কেটে নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন তিনি। বাচ্চু মাঝি নামের এক দালালের মাধ্যমে নৌকায় ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চুক্তি করে বোরকা পরে ঘাটে যান। সেখান থেকেই র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে বলে দাবি করা হয়।
গতকাল সকালেই সাহেদকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। র‌্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তাকে মিডিয়ার সামনে নেয়ার ‘বায়না’ ধরেন সাহেদ। দুপুরে তাকে নিয়ে উত্তরায় একটি অফিসে তল্লাশি চালিয়ে দেড় লাখ টাকার জাল নোট জব্দ করে র‌্যাব। বিকেলে সহযোগী মাসুদ পারভেজসহ সাহেদকে তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গতকাল অস্ত্র আইনে দেবহাটা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় জাল নোটের আরেকটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছিলো। আজ বৃহস্পতিবার দুজনকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করবে ডিবি।
সাহেদের বিরুদ্ধে ৫৯টি মামলা হওয়ার তথ্যসহ গত কয়েক দিনে শত শত ভুক্তভোগী র‌্যাবের কাছে অভিযোগ জানান। গতকাল গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ভুক্তভোগীরা র‌্যাবের কার্যালয়ে ভিড় করেন। সাহেদ আগের মতোই পার পেয়ে যাবেন কি না, সে শঙ্কায় আছেন তারা। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সাহেদ আইনের হাত থেকে আর রেহাই পাবেন না। তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাতক্ষীরায় জন্ম নেয়া সাহদকে ‘এলাকার কলঙ্ক’ অভিহিত করে স্থানীয়রাও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে।
গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে এক বিফ্রিংয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার বলেন, দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর সীমান্তের কোমরপুর বেইলি ব্রিজের দক্ষিণ পাশে নদীর পার থেকে সাহেদকে একটি অবৈধ অস্ত্র, তিন রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। সাহেদ বোরকা পরে বাচ্চু দালালসহ কয়েকজন দালালের মাধ্যমে নৌকায় উঠে ইছামতী নদী পার হয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে সাহেদ তার চুল ও গোঁফ ছেঁটে ফেলেন এবং চুলে কালো রং করেন। গ্রেফতারের সময় তার সঙ্গে র‌্যাব সদস্যদের ধস্তাধস্তি হয়।
ব্রিফিং শেষে সকাল সাড়ে ৮টায় তাকেসহ র‌্যাব সদস্যরা দুটি হেলিকপ্টারে ঢাকায় ফেরেন। দুপুর ১২টার দিকে সাহেদকে নিয়ে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, সেটিও সাহেদের আরেকটি অফিস। বিকেল ৩টায় র‌্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সাহেদ করিম নিজেকে যতই ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করুক না কেন, সে মূলত চতুর, ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু।’ অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এনে সাহেদ ও তার সঙ্গী মাসুদকে নিয়ে অভিযানে যায় র‌্যাব। সেখান থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার টাকার জাল নোট জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ ও ভুক্তভোগীর প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্তকারীর কাছে তাকে হস্তান্তর করব। তারা দেখবেন। অনেক ভুক্তভোগী আমাদের কাছে এসেছেন। তাঁদের আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি, সহায়তাও করছি।’ ইন্ধনদাতারের গ্রেফতার এবং আরো অস্ত্র উদ্ধারের প্রশ্নে র‌্যাব ডিজি বলেন, ‘আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। এমন কিছু তথ্য থাকলে নিশ্চয়ই মেধাবী তদন্ত কর্মকর্তা তা দেখবেন।’
গতকাল বিকেল ৫টার দিকে র‌্যাব সাহেদ ও মাসুদকে মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে হন্তান্তর করে। এ সময় র‌্যাব ও ডিবির সদস্যরা সাহেদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। পরে ফের ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহাবুবুল আলম বলেন, আসামিদের আজ আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More