ইসলামি আন্দোলনের চার উজ্জ্বল নক্ষত্র

মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাই পির আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম, মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তাদের জীবন যেন এক দীপ্ত নক্ষত্রের মতো। যার আলো আজও আমাদের পথ দেখায়। তারা প্রত্যেকেই ইসলামের শিক্ষা, দাওয়াত ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেগেছেন। ইসলামি আন্দোলনের এ চার উজ্জ্বল নক্ষত্র নিয়ে লিখেছেন-তোফায়েল গাজালি

মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর

আশির দশকে বাংলাদেশের আকাশে ইসলামি আন্দোলনের যে আলো জ্বলে ওঠেছিল, তার অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)। বহুমাত্রিক প্রতিভার এই আলেম ছিলেন রাজনীতিতে তওবার আহ্বান নিয়ে আসা একজন যুগপ্রবর্তক।

১৮৯৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার লুধুয়া গ্রামের তার জন্ম। বাবা ইদ্রিস ও মা খাদিজার স্নেহধন্য পরিবেশেই শুরু হয়েছিল লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পরে তিনি ভারতের পানিপথে পাড়ি জমান এবং সেখানে কুরআন শরিফ মুখস্থ ও তাজবিদে মুন্সিয়ানা অর্জনের পর উস্তাদ তাকে ‘হাফেজ্জী’ উপাধি দেন।

১৯১৬ সালে মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর পরামর্শে সাহারানপুরের মাজাহির উলুমে ভর্তি হয়ে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষা নিতে দারুল উলুম দেওবন্দে যান এবং দেশের মাটিতে ফিরে আসেন দ্বীনের এক বিদগ্ধ পণ্ডিত ও নীতিবান আলেম হয়ে।

তার জীবন শুধু আধ্যাত্মিক সাধনা বা ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি বুঝেছিলেন, নৈতিকতাহীন রাজনীতি জাতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে। তাই তিনি নাম দিলেন ‘তওবার রাজনীতি’। তার আহ্বান ছিল পাপ বর্জন করে সততা, ন্যায় ও নৈতিকতার ভিত্তিতে রাজনীতি করার।

১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘খেলাফত আন্দোলন’। একই বছরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বটগাছ প্রতীকে অংশগ্রহণ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, যেখানে দশটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি আবারও রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।

হাফেজ্জী হুজুর শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও শান্তির দূত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৮২ সালে ইরান ও ইরাক সফরে গিয়ে তিনি ইমাম খামেনি ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যুদ্ধ থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তার হৃদয় ছিল মানবপ্রেমের এক বিশাল ময়দান।

৭ মে ১৯৮৭ সালে তিনি দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান পরপারে। জ্যেষ্ঠ পুত্র মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ইমামতিতে ঢাকার জাতীয় ঈদগাহে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) ছিলেন-সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন। জ্ঞান, চিন্তা, আন্দোলন ও নেতৃত্বের বিরল সমন্বয় ঘটেছিল তার জীবনে। তিনি ছিলেন কুরআন-হাদিসের দীপ্ত আলোয় আলোকিত, সমাজ-সংস্কারে নিবেদিত এবং ইসলামি আন্দোলনের বীর সিপাহসালার।

১৯১৯ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার ভিরিচ খাঁ গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ এরশাদ আলী এবং মা হাজেরা বেগম। মাত্র সাত বছর বয়সেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামেয়া ইউনুসিয়ায়। সেখানেই শুরু হয় তার শিক্ষাযাত্রা। চার বছর অধ্যয়ন শেষে ১৯৩১ সালে ভর্তি হন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বড়কাটারা মাদ্রাসায়। টানা ১২ বছর অধ্যয়ন শেষে সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করেন দাওরায়ে হাদিস। এ সময় তিনি আল্লামা যফর আহমদ উসমানী, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী ও হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর মতো প্রখ্যাত শায়খদের সান্নিধ্যে আলোকিত হন।

উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে পাড়ি জমান ভারতের বোম্বে প্রদেশে। সুরতের ডাভেল জামেয়ায় অধ্যয়ন করেন মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী ও মাওলানা বদরে আলম মিরাঠীর মতো বিদগ্ধ আলেমদের কাছে। সর্বশেষ দারুল উলুম দেওবন্দে মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলবীর তত্ত্বাবধানে অর্জন করেন তাফসিরের উচ্চতর জ্ঞান।

দেশে ফিরে শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকার বড়কাটারা মাদ্রাসায়। ১৯৫২ সালে লালবাগ মাদ্রাসায় বুখারি শরিফ পাঠদান শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেও ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বুখারি শরিফের পাঠদান করেছেন। রাজধানীসহ সারা দেশের বহু মাদরাসায় তিনি হাদিসের শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়েছেন।

ছাত্রজীবনেই ‘ইংরেজ খেদাও’ আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তান আমলে নেজামে ইসলাম পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতির দায়িত্ব নেন।

হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলনে নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। ১৯৯১ সালে কয়েকটি ইসলামি দল নিয়ে গঠন করেন ইসলামী ঐক্যজোট; যার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি নিজে।

১৯৯৩ সালের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ লংমার্চ তার নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়, যেখানে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নেয়। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় হাদিস পাঠদানকারী এই মহিরুহ ২০১২ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার আজিমপুরে নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন।

চরমোনাই পির সৈয়দ মোহাম্মাদ ফজলুল করীম

১৯৩৫ সালে বরিশালের চরমোনাইতে জন্ম নেন সৈয়দ মোহাম্মাদ ফজলুল করীম (রহ.)। চরমোনাই পির হিসেবে তিনি পরিচিত। বাবা ছিলেন প্রখ্যাত ওলি ও চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ মাওলানা সৈয়দ ইছহাক (রহ.)। বাবার কাছেই শৈশবে দ্বীনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা উত্তরসূরি খেলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকারী।

শিক্ষার অগ্রযাত্রায় তিনি চরমোনাই আলিয়া মাদরাসা থেকে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫৭ সালে ঢাকার লালবাগ মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। এরপর নিজ দরবারেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং দাওয়াতের কাজে আজীবন যুক্ত থাকেন।

১৯৭৩ সালে সৈয়দ ইছহাকের (রহ.) ইন্তেকালের পর তিনি আমিরুল মুজাহিদীনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নাছিরে মিল্লাত’ নামে একটি সংগঠন; যার মাধ্যমে ছাত্রসমাজকে দ্বীন ও সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ করেন।

ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। বাবার সঙ্গে নেজামে ইসলাম পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং হাফেজ্জী হুজুরের নির্বাচনী কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’র প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। এ সংগঠনের আমির হিসেবে তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা, ভ্রান্ত আকিদার মোকাবিলা এবং ইসলামী রাজনীতির ঐক্যের জন্য তিনি ছিলেন আপসহীন।

১৯৯১ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে ইসলামি শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। আরাফাতের প্রান্তরে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি সাম্রাজ্যবাদী জাতিসংঘের বিকল্প হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর ইসলামি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। ২০০১ সালে ফতোয়াবিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে তিনি কাফনের কাপড় পরে আন্দোলন শুরু করেন; যা সারা দেশে আলোড়ন তোলে।

আল্লাহর এই ওলি ছিলেন সত্যের পথে আপসহীন সংগ্রামী। তার জীবন ছিল দ্বীনের দাওয়াত, ইসলামি আন্দোলন ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। লাখো কোটি মানুষের হৃদয়ে আজও তিনি সাহস ও ইসলামি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বেঁচে আছেন। ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরের নীরবতায় চরমোনাইয়ের নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মুফতি ফজলুল হক আমিনী

মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ। ১৫ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমীনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৬১ সালে ঢাকার জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়ায় ভর্তি হন এবং দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তানের করাচি নিউ টাউন মাদরাসায় ভর্তি হয়ে উলুমুল হাদিসে এক বছরের উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।

১৯৭০ সালে ঢাকার মাদরাসা-ই-নূরিয়ায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে যোগ দেন জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগে এবং ১৯৮৭ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া বড়কাটারা আশরাফুল উলুমসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সেবা করেছেন।

রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ১৯৮০-এর দশকে খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ইসলামি আইন, শিক্ষানীতি ও সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি সারা দেশে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও শিক্ষা নীতিমালার বিরোধিতা ও হাইকোর্টের ফতোয়া-সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয়।

২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর ৬৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জাতীয় ঈদগাহে জানাজা শেষে জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগে তাকে সমাহিত করা হয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More