আরবের আকাশে তখনো ভোর হয়নি। অন্ধকার শুধু রাতের নয়, ছায়া হয়ে নেমে এসেছিল মানুষের হৃদয়ে। গোত্রের অহংকারে ভাঙা ছিল সমাজের বন্ধন, শক্তিশালীরা দুর্বলকে গিলে খেত অনায়াসে।
নারী ছিল অবমাননার প্রতীক, কন্যাশিশু জন্ম নিলেই মাটির নিচে চাপা পড়ত। দাসেরা মানুষ হিসেবে নয়, পণ্য হিসেবে গণ্য হতো। মূর্তির সামনে মানুষ নতজানু, অথচ মানবতার সামনে কেউ নত হতে জানত না। চারদিকে এক গাঢ় আঁধার—যেন মরুর অনন্ত ধূলিঝড় গ্রাস করে নিয়েছে আশার আলো।
ঠিক তখনই, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়ালের এক ভোরে, মক্কার সম্মানিত কুরাইশ বংশে জন্ম নিলেন এক শিশু। নাম রাখা হলো মুহাম্মদ—“প্রশংসিত।” জন্মের আগেই পিতাকে হারালেন তিনি; ছয় বছর বয়সে মায়ের স্নেহও চলে গেল।
এতিমের নিঃসঙ্গতা তার জীবনের সঙ্গী হলো, তবুও সেই একাকীত্ব তাকে ভেঙে দিল না, বরং গড়ে তুলল মানবতার গভীরতায় সিক্ত এক মমতাময় হৃদয়।
দাদা আব্দুল মুত্তালিব, পরে চাচা আবু তালিবের স্নেহে বড় হতে হতে শিশুটি নিজেকে আলাদা করে তুললেন। ভেড়া চরাতে চরাতে কিংবা ব্যবসার কাজে মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে তিনি প্রমাণ করলেন—সত্যবাদিতা কোনো শব্দ নয়, বরং জীবনের মূল ভিত্তি। তার সততা এতটাই দীপ্তিমান হয়ে উঠল যে, মক্কার মানুষ তাকে নাম দিল “আল-আমিন” বা অতুলনীয় বিশ্বস্তজন।
যৌবনে তিনি ব্যবসার কাজে বের হলেন, আর তার সততা নজরে পড়ল ধনী ব্যবসায়ী নারী খদিজার। তিনি শুধু তার কাজে মুগ্ধ হলেন না, বরং তাকে জীবনসঙ্গী করে নিলেন। এভাবেই মুহাম্মদ পেলেন জীবনের প্রথম আশ্রয়, প্রথম শান্তির ছায়া।
কিন্তু চারপাশের অমানবিকতা তাকে শান্ত থাকতে দিল না। রাতের পর রাত তিনি হারিয়ে যেতেন মক্কার উপকণ্ঠের হেরা গুহায়। পাহাড়ের নীরবতায় বসে ভাবতেন—কেন এত অন্যায়? কেন এত অবিচার? কোথায় মানবতার মুক্তি?
এক রাতে সেই গুহায় নেমে এলো আসমানি বার্তা। ফেরেশতা জিবরাইল তার কানে প্রথম যে শব্দ তুললেন, তা ছিল—‘ইক্রা’-পড়ো।” মুহূর্তেই বদলে গেল পৃথিবীর ইতিহাস। মুহাম্মদ বুঝলেন, তিনি এখন একজন সাধারণ মানুষ নন, তিনি নবী, আল্লাহর প্রেরিত বার্তাবাহক।
এই ঘোষণা মক্কার ক্ষমতাধর শ্রেণি শুনতে চাইল না। তারা তাকে তুচ্ছ করল, অপমান করল, তার অনুসারীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাল। দাস বিলালকে উত্তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে রাখা হলো, খবাবকে আগুনে পোড়ানো হলো, সুমাইয়া শহীদ হলেন নির্যাতনের যন্ত্রণায়। অথচ রাসূল সা. ছিলেন অবিচল। তিনি বললেন—‘ধৈর্য ধরো, আল্লাহর সাহায্য আসবেই।’
তার জীবনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্ত এলো তায়েফে। তিনি গিয়েছিলেন মানুষের হৃদয় জয়ের বার্তা নিয়ে। কিন্তু তাকে বিদ্রূপ করা হলো, রাস্তায় পাথর ছুঁড়ে রক্তাক্ত করা হলো।
আহত শরীরে তিনি যখন আকাশের দিকে হাত তুললেন, তার ঠোঁটে ফুটল শুধু এই দোয়া—“হে আল্লাহ, ওদের ক্ষমা করো, কারণ ওরা জানে না।” প্রতিশোধ নয়, তার অস্ত্র ছিল ক্ষমা; ঘৃণা নয়, তার শক্তি ছিল দয়া।
মক্কার দীর্ঘ নির্যাতনের পর তিনি হিজরত করলেন মদিনায়। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান—সবাই ছিল সমান নিরাপত্তার অধিকারী। তিনি গড়ে তুললেন ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র, যেখানে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, প্রভু-দাস—সবার জন্য ছিল মর্যাদার নিশ্চয়তা।
কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হয়েও তিনি রাজকীয় জীবনে প্রবেশ করেননি। তার বিছানা ছিল খেজুরপাতার, খাদ্য ছিল সাধারণ, কাপড় ছিল সাধারণ মানুষের মতোই সাদামাটা। তিনি দরিদ্রের সঙ্গে একই আসনে বসতেন, এতিমের মাথায় হাত রাখতেন, নারীর সম্মানকে মানবতার সম্মানে রূপ দিতেন।
অবশেষে এলো সেই ঐতিহাসিক দিন—মক্কা বিজয়ের দিন। একসময়ের শত্রুরা ভয়ে কাঁপছিল, ভাবছিল প্রতিশোধের ঝড় বয়ে যাবে। অথচ মুহাম্মদ সা. দাঁড়িয়ে বললেন—“আজ তোমাদের জন্য কোনো শাস্তি নেই।” এই এক বাক্যে তিনি প্রমাণ করলেন, বিজয়ীর মহত্ত্ব প্রতিশোধে নয়, বরং ক্ষমায়।
মুহাম্মদ সা. এর জীবনী তাই কোনো সাধারণ ইতিহাস নয়, বরং মানবতার অনন্ত আলো। তিনি ছিলেন পিতা, স্বামী, বন্ধু, শিক্ষক, রাষ্ট্রনায়ক, কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন দয়ার প্রতিমূর্তি। তার জন্মের ভোর কেবল একটি শিশুর জন্ম নয়, বরং অন্ধকার ভেদ করা এক মহাজাগতিক সূর্যোদয়।
মিলাদুন্নবী সেই সূর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়, যিনি আমাদের শিখিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে ঘৃণাকে জয় করা যায়, ন্যায় দিয়ে অন্যায়কে পরাজিত করা যায়, দয়া দিয়েই পৃথিবীকে আলোকিত করা যায়। আজকের বিভেদময়, অস্থির পৃথিবীতে তার জীবন আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক পথনির্দেশ।
মুহাম্মদ সা. এর জন্ম যেন সময়ের বুক থেকে শোনানো এক মহাকাব্য—যা পড়লে হৃদয় আলোয় ভরে যায়, আর আত্মা খুঁজে পায় মুক্তির সোপান।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.