প্রতিদিন বাগানেই নষ্ট হচ্ছে দেড় কোটি টাকার ফুল

করোনার কারণে ফুল বিক্রি বন্ধ : বিপাকে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের চাষীরা

স্টাফ রিপোর্টার: গ্লাডিওলাস, জারবেরা, গোলাপ, গাদা এবং রজনীগন্ধাসহ ২০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ করেছেন চুয়াডাঙ্গার কেদারগঞ্জের মৎস্য ভবন সড়কের চাষী আলম আলী। প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করতেন তিনি। করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে ফুল বিক্রি। এ পরিস্থিতিতে প্রতিদিন শ্রমিক দিয়ে ফুল কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে তাকে। একদিকে ফুল নষ্ট ও শ্রমিকের খরচ, অন্যদিকে বাগান রক্ষণাবেক্ষণের নিয়মিত ব্যয়; সবমিলিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন আলম আলী। ১০ দিন আগে আলম আলীকে ছয় বিঘার গাদা, এক বিঘার গ্লাডিওলাস গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। মার্চ থেকে এ পর্যন্ত তারা অন্তত ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। ফুল চাষই তার উপার্জনের একমাত্র উৎস। বর্তমান অবস্থা থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন তা নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। বললেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। এক টাকাও রোজগার নেই, খরচ আছে। চোখে অন্ধকার দেখছি।’

শুধু এই একজন চাষী নন, তার মতো দেশের দেড় লাখ ফুলচাষী আছেন মহাসংকটে। জমি থেকে প্রতিদিন ফুল কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করতে না পেরে গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে হাজার হাজার বিঘা জমির। চাষী ছাড়াও শ্রমিক, পরিবহন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের সাড়ে ২৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয় ফুল ব্যবসা ঘিরে। তারাও বেকার হয়ে গেছেন। ফুলচাষীরা সরকারের কাছে অনুদান অথবা স্বল্পসুদে ঋণ দাবি করেছেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক বাবুল প্রসাদ জানান, সারাদেশে দেড় লাখ ফুলচাষী আছেন। ফুলের আবাদ হয় ২৫ হাজার একর জমিতে। চাষী ছাড়াও ফুলের সঙ্গে শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ আরও সাড়ে ২৮ লাখ মানুষ যুক্ত। চাষী থেকে শুরু করে ফুলের খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত প্রতিদিন এ খাতে গড়ে লেনদেন হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রান্তিক চাষীরা ফুল বিক্রি করে পান দেড় কোটি টাকা। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষীরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও অনেক চাষী ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি-না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বাবুল প্রসাদ বলেন, ২৬ মার্চ ও পহেলা বৈশাখ- এই দু’দিনে ২০-২২ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হতো। এবার সেটা হয়নি। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি ফুলচাষীদের টিকিয়ে রাখতে অনুদান বা স্বল্পসুদে ঋণ দাবি করেন।

ফুল ব্যবসায়ীরা জানান, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর ও নাটোরসহ দেশের ২৪ জেলায় ফুলচাষ হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় কিছু জমিতে ফুল চাষ হয়। সবচেয়ে বেশি ফুলচাষী যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মানিকগঞ্জে। দেশি ফুলের পাশাপাশি বিদেশি নানা জাতের ফুল চাষ করেন তারা। ফুলের বড় মার্কেট রাজধানীর শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে। প্রতিদিন এই দুটি মার্কেটে ৬০-৭০ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ফুলের পাইকারি মার্কেট আছে। ফুল মার্কেটের শ্রমিকরাও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।

এবার সাত বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছিলেন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বাকশপোতা গ্রামের ফুলচাষী জিকু মণ্ডল। করোনায় টানা ছুটিতে ফুল বিক্রি না হওয়ায় প্রতিদিন ফুল কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। ফুল কাটতে শ্রমিক খরচ এবং গাছের রক্ষণাবেক্ষণে সপ্তাহে ৫-৭ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এ কারণে গত সপ্তাহে গাদা ও চন্দ্রমল্লিকা গাছ কেটে ফেলে জমিতে চাষ দিয়েছেন। তিনি বলেন, গাদা ও মল্লিকা চাষে তার আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে তিনি অন্তত ১০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতেন। এখন পথে বসার অবস্থা হয়েছে।

যশোরের মনিরামপুরের বাইশা গ্রামের আকবর আলী বলেন, তার সাড়ে তিন বিঘা জমিতে গ্লাডিওলাস ও রডস্টিক যখন বিক্রির সময় এলো, ঠিক তখনই গাড়ি চলাচল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। একট ফুলও বেচতে পারেননি। গাছ উপড়ে ফেলেছেন। এখন ওই জমিতে পাট বোনার চিন্তাভাবনা করছেন।

ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার মুণ্ডমালা গ্রামের ফুলচাষী ওয়াজ্জেল হোসেন গাদা, রজনীগন্ধা ও চন্দ্রমল্লিকা চাষ করেছেন সাড়ে আট বিঘা জমিতে। বিক্রি বন্ধ থাকায় গত সপ্তাহে চন্দ্রমল্লিকার গাছ কেটে ফেলেছেন। এ চাষে খরচ হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার টাকা। ওয়াজ্জেল স্থানীয় ন্যাপা মোড়ের ফুলবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি। তিনি বলেন, ন্যাপা, শ্যামকুর ও কাজীরবেড়- এই তিন ইউনিয়নে ৯ শতাধিক ফুলচাষী প্রায় ছয়শ’ একর জমিতে ফুলের আবাদ করেন। মার্চের মাঝামাঝি থেকে বিক্রি একেবারেই বন্ধ। কয়েকশ’ বিঘা জমির ফুল গাছ উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ফুলচাষিরা ধ্বংসের মুখে। অভাব-অনটনে আছেন তারা।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More