মেহেরপুরের গাংনীতে হত্যা ও ধর্ষণের পৃথক দুটি মামলার রায় স্ত্রী হত্যায় স্বামীর ও কিশোরী ধষর্ণের দায়ে প্রেমিকের যাবজ্জীবন
মেহেরপুর অফিস: মেহেরপুরে নারী হত্যা ও ধর্ষণের পৃথক দুটি মামলায় দুই ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আদালত। জেলা ও দায়রা জজ এসএম নাসিম রেজা গতকাল সোমবার স্ত্রী হত্যা মামলায় গাংনীর সেন্টুকে যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই বছরের কারাদ- দেন। সাজাপ্রাপ্ত স্বপন মোহাম্মদপুর গ্রামের এনামুল হকের ছেলে। একইদিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. তহিদুল ইসলাম কিশোরী ধর্ষণের মামলায় স্বপন আলীকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- , দুই লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদ- দেন। দ-প্রাপ্ত সেন্টু মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আকুবপুর বাজারপাড়ার ইমরুল ইমামের ছেলে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের জুন মাসে সেন্টু তার স্ত্রী সাগরিকা খাতুনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যার পর বিষয়টি আত্মহত্যা বলে প্রচার চালাতে থাকে। কিন্তু সাগরিকার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করা হলে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়। বহু জল্পনা-কল্পনার পর, ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট সকল নথি ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সেন্টুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা (দ-বিধি ৩০২/২০১ ধারা) গঠন করা হয়। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলাটি আদালতে চলে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মোট ১৭ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। প্রত্যেকের সাক্ষ্যে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠে সেন্টুর পরিকল্পিত ও নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের চিত্র। প্রমাণিত হয়, স্ত্রীকে ঠা-া মাথায় হত্যা করার পর সেন্টু সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। রায়ে বিচারক বলেন, একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে নিরাপত্তা ও ভালোবাসা প্রত্যাশা করেন। কিন্তু সেই স্বামীই যদি তার প্রাণ সংহার করে, সেটি সমাজ ও ন্যায়ের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। তিনি আরও বলেন, “অপরাধ যতো পুরোনোই হোক, সত্য কখনও চাপা থাকে না। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রমাণ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।” মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাড. সাইদুল রাজ্জাক। তিনি বলেন, “এই রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রমাণের ভিত্তিতেই আদালত দ- দিয়েছেন।” অন্যদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাড. একেএম নুরুল হাসান রঞ্জ। তিনি রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
অপরদিকে, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের স্বপন আলীকে (৩৪) কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে ২ লক্ষ টাকা অর্থদ-ে দ-িত করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- ভোগ করতে হবে তাকে। গতকাল সোমবার দুপুরে মেহেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও জেলা ও দায়রা জজ মো. তহিদুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। সাজাপ্রাপ্ত স্বপন মোহাম্মদপুর গ্রামের এনামুল হকের ছেলে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হিসেবে ছিলেন ইসরাত জাহান তমা। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাড. আতাউল হক আনটু।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর গাংনী উপজেলার স্বপনের সঙ্গে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রাজনগর গ্রামের রাহাতুল ফকিরের ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে স্বপন মোবাইল ফোনে মেয়েটিকে ডেকে নেয়। সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরার পর রাত আনুমানিক ১১টা ৩০ মিনিটে গাংনীর আকবপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের নির্মাণাধীন একটি দ্বিতল ভবনের ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে এবং রাতেই তাকে ফেলে পালিয়ে যায়।
ভিকটিম পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে ঘটনাটি তার পরিবার ও স্থানীয়দের জানায়। পরে তার বাবা রাহাতুল ইসলাম ফকির বাদী হয়ে গাংনী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(১) ধারায় স্বপন আলী ও সাহারুল নামে আরও একজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার পায় কুমারিডাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মিন্টু মিয়া। তদন্ত শেষে তিনি কেবল স্বপনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় মোট ৮ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত স্বপনের বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৫ ধারামতে আসামির আরোপিত ২ লাখ টাকার অর্থদ- ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হবে। যদি আসামির বর্তমান কোনো সম্পদ না থাকে, তবে ভবিষ্যতে অর্জিত সম্পদ থেকেও এই অর্থ আদায়যোগ্য হবে। এবং এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো দাবির চেয়ে ভিকটিমের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার অগ্রাধিকার পাবে।
উল্লেখ্য, ঘটনা ঘটেছিলো ২০১৬ সালে। দীর্ঘ তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার পর প্রায় ৯ বছর পর আদালত এ রায় ঘোষণা করল। ভিকটিমের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.