মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত সেবা ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন ভবনে শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম

তৌহিদুল ইসলাম তুহিন, মেহেরপুর: ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৮তলা নতুন ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ভবন এবং ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪ তলা বিশিষ্ট সার্ভিস ভবনে ভিতের আবাস, ভবন দুটিতে শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম মেহেরপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। চিকিৎসকের অভাব, আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতির বিকল অবস্থায় পড়ে থাকা এবং দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন জেলার প্রায় আট লাখ মানুষ। তবে বিদ্যামান পরিসরে যতটুকু সেবা দেয়া যায় সেক্ষেত্রে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উপর। গত এক সপ্তাহ সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০০ রোগী অপেক্ষা করেন চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায়। এছাড়া ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি থাকছেন ২৭০ থেকে ২৮০ জন রোগী। শয্যা ছাড়াও অনেক রোগীকে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সকল বেডসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের কিছু বেডে বাসা বেধেছে ছারপোকা।
সরেজমিনে আরও যা দেখা গেলো; তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের যোগসাজসে ওষুধ এবং বিভিন্ন টেস্টের কিট বাইরে বিক্রির অভিযোগ স্টোরকীপার পলির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ দীর্ঘ দিনের হলেও বিগত ১৭ বছরের মত এখনো তিনি বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে দাপটের সাথে একই যায়গায় রয়ে গেছেন।
হাসপাতালের ওষধ, খাবার সরবরাহ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম সাপ্লাই এর টেন্ডার নিয়ে রয়েছে বিএনপি দুই গ্রুপের হাসপাতালে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা।
নতুন ভবনে শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম: পড়ে আছে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৮ তলা নতুন ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ভবন এবং ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চার তলা বিশিষ্ট সার্ভিস ভবন।
৩টি সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের একটি সচল: হাসপাতালে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি সচল রয়েছে। আর একটি মাঝে মধ্যে রিপেয়ার করে চালাতে হয়। অ্যাম্বুলেন্স চালকও রয়েছেন একজন। আর একজনকে আউটসের্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এইচডিইউ—তে যন্ত্র বিকল, নেই মনিটরিং ব্যবস্থা: হাসপাতালের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ১০টি শয্যা থাকলেও, ছয় মাস ধরে হার্ট মনিটর ও অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফলে রোগীরা সঠিক পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এই ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ শিউলি ম-ল বলেন, ‘মেশিনগুলো অকেজো হওয়ার পর বারবার লিখিতভাবে জানানো হলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।‘
প্রসূতি ওয়ার্ডে চিকিৎসক নেই, সিজারিয়ান যাচ্ছে ক্লিনিকে: মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে ভর্তি হন ৬৪০ জন। এর মধ্যে মাত্র ৪ জনের সিজারিয়ান অপারেশন হয় হাসপাতালে। আর হাসপাতালে সেবা নিতে আসা ৪৯২ জনকেই শহরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করাতে হয়েছে। গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়।
প্রসূতি ওয়ার্ডে যেয়ে দেখা যায় সেখানে একজন সেকমো চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নার্স ইনচার্জ শিউলি সরকার বলেন, ‘গাইনি ম্যাডাম না থাকায় অনেক রোগীকেই হাসপাতাল থেকে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ম্যাডাম নিজেও অপারেশন করছেন।‘ জনবল সংকট: ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে ঔষুধ, খাবার, নার্স ও শয্যার বরাদ্ধ ঠিক থাকলেও চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল কাগজে কলমে এখনও বরাদ্দ ১০০ শয্যা হাসপাতালের অনুপাতে, মাত্র ৪২ জন। তবে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ৪২ জন চিকিৎসকের বরাদ্দ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২১ জন। আর যে ২১টি গুরুত্বপূর্ণ পদ শুন্য রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মেডিসিন, শিশু, সার্জারি, গাইনি, কার্ডিওলজিস্ট, চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, প্যাথলজির মত বিশেষজ্ঞ পদ। ইমারজেন্সী মেডিকেল অফিসারের ৭টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১ জন। মেডিকেল অফিসার ১১ জনের স্থলে কর্মরত রয়েছেন ৯ জন। উচ্চশিক্ষার জন্য আরও ৪ জন প্রেষণে বদলি হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, ফলে চিকিৎসক সংকট আরও প্রকট হবে।
সিনিয়র স্টাফ নার্স ইসমত আরা বলেন, আগে র‌্যাবিস ভ্যাক্সিনের মুজুত ছিল না। মারচ মাসে নতুন টেন্ডারের ঔষুধ আসলে আমাদের বিভাগে ৯১০ টি ভ্যক্সিন দেয়া হয়। সেই মুজুদ থেকে আমরা মার্চ মাসে ২৩১, এপ্রিলে ৪১৪ ও মে মাসে ১৭৪ জনকে হাস্পাতাল থেকে বিনামুল্যে ভ্যাক্সিন দিয়েছি।
প্যাথলিজ বিভাগে একজনকে দিয়ে চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ। ফলে প্রতিদিন অধিকাংশ রোগী বিভিন্ন ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে বেশি অর্থ খরচ করে টেস্ট করাচ্ছেন। ফলে সরকারি অল্প খরচের সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ ওমর ফারুক বলেন, ‘পাঁচ জনের কাজ একজনকে করতে হচ্ছে। ফলে দিনে ৫০টির বেশি স্যাম্পল নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও সিভিল সার্জন অফিস থেকে বিদেশগামীদের মেডিকেল টেস্টের জন্য অতিরিক্ত কাজ করা লাগছে। যার ফলে হাসপাতালের রোগীদের বাইরে যেয়ে টেস্ট করাতে হচ্ছে। জনবল না বাড়ালে সকল রোগীর টেস্ট করা সম্ভব হবে না।‘
ওমর ফারুক আরও বলেন, ‘মে মাস থেকে কীট সংকটে ডোপটেস্ট করা বন্ধ রয়েছে। তবে এর আগে গত মাসে ২ জন ব্যক্তির ডোপটেস্ট করা হয়েছিলো।‘
ওষুধের টেন্ডারের মাধ্যমে মাত্র কিছুদিন আগেই ১২ হাজার ডোপটেস্টের কিট আনা হলেও সেগুলি হাসপাতালের স্টোরকীপার পলি হাসপাতালের অন্য কর্মচারীদের যোগসাজশে কালবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন, নির্ভরযোগ্য সুত্র থেকে এমন তথ্য জানতে পেরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় তার সাথে। স্টোরকীপার পলিকে মোবাইলে কল দিলে তিনি এই বিষয়ে কোন কথা বলবেন না বলে ফোনটি কেটে দেন। এর পর প্রতিবেদক পর পর ৪ দিন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে যেয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবেদককে দেখলেই তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে আত্মগোপন করার পন্থা বেছে নেন।
আরএমও ডা. সউদ কবির মালিক বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে জনবল ও চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। এই অল্প জনবল নিয়েই আমরা নিরলস ভাবে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এছারাও ৪র্থ শ্রেনীর জনবল সংকটের কারণে আমরা নবনির্মিত ভবনে কার্যক্রম শুরু করতে পারছি না।‘ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শাহারিয়া শায়লা জাহান বলেন, ‘চিকিৎসক ও জনবল সংকট থাকায় সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও বিদ্যমান জনবল নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। দালাল চক্র সরাতে চেষ্টা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে শুন্য পদে জনবল নিয়োগের জন্য।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More