স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস লুটপাট হওয়া সম্পদ ও অর্থ পুনরুদ্ধারের পর সেই সম্পদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠনের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারের অগ্রগতি নিয়ে এক সভায় তিনি এ নির্দেশনা দেন। সভায় প্রধান উপদেষ্টা সভাপতিত্ব করেন। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস বিফ্রিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, লুটপাট হওয়া অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি তহবিল গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা জনকল্যাণে ব্যবহার করা হবে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই তহবিল বর্তমান আইন অনুযায়ী গঠিত হবে। তবে প্রয়োজনে তহবিল গঠনের জন্য আইন সংশোধন করা হবে। তিনি বলেছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফান্ড (লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল) গঠন করা হবে। ব্যাংক ক্ষতিপূরণ এবং জনহিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের ফান্ড গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা, যেটার অর্থ দিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারব। কারণ ব্যাংকগুলো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের টাকা তো লুট করা হয়েছে। এছাড়া বাকি টাকা যেগুলো নন ব্যাংক রিলেটেড, যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে, সেগুলো সরকার আরেকটা ফান্ডে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করবে। সবই আইনগতভাবে করা হবে। কোনোটাই আইনের বাইরে হবে না।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয়, সেটার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি। সাধারণত এটি করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে, সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছর খানেকের মধ্যে করা সম্ভব। প্রথমে আইনের প্রক্রিয়া আমাদের দেশের সম্পন্ন করতে হবে, তারপর সঠিক প্রণালীতে বিদেশে রিকোয়েস্ট করতে হবে। যেটাকে বলা হয় মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স (এমএলএ)। আমরা এখন প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের পাশাপাশি ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর এক লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার অর্থ অ্যাটাচমেন্ট আছে। এর মধ্যে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার (প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা) স্থাবর এবং ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি স্থিতি (ফ্রিজিং) অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে ২৫৩ কোটির (২ কোটি ৭ লাখ ডলার) অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ আছে। এই অর্থ থেকে একটি ‘লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করা হবে, যা সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকবে।
উল্লেখ্য, সরকার গঠিত ১১টি তদন্ত দলের অনুসন্ধানে ১০ শিল্পগোষ্ঠীসহ শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাংকঋণে অনিয়ম, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে এসব ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকার একটি বিশেষ অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে, এই অর্থ উদ্ধারে কোন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নির্ধারণের কাজও চলছে। বিগত সরকারের সময়ে অর্থ পাচারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে দুদক সেটা তদন্ত করবে। তদন্ত করে যদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আনা যাবে, তাহলে সেটা তারা নিয়ে আসবে। এখানে দুদককে কেউ বাধা দিচ্ছে না। দুদক নিজস্ব প্রক্রিয়া এ কাজটি করছে। এখানে আমার মন্তব্য করাটা একেবারেই সমুচিত নয়। নগদের ২ হাজার কোটি আত্মসাৎ: নগদের সাবেক ম্যানেজমেন্ট প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে কোর্টে আপিল করা হয়েছে এবং শিগিগরই শুনানির তারিখ নির্ধারিত হবে। ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে যেন নতুন করে বড় ক্ষতির সুযোগ না থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আগের যারা ম্যানেজমেন্টে ছিল সম্প্রতি তারা সেটা আবার দখল করেছে। এ প্রক্রিয়াটা এখন কোন পর্যায়ে আছে? আহসান এইচ মনসুর বলেন, নগদের বিষয়ে আমাদের পজিশন সুস্পষ্ট। আমরা মনে করি নগদের যারা অরিজিনাল ম্যানেজমেন্ট ছিল, বোর্ড ছিল তারা অর্থনৈতিক দুর্নীতি করে টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমরা জানি ৬৫০ কোটি টাকা তারা ই-মানি ক্রিয়েট করেছে। যেটা আসলে প্রকৃত অর্থ ছিল না। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির আওতায় যেসব টাকা ট্রান্সফার করা হতো সেগুলো নগদের মাধ্যমে করা হতো। সেখানে তারা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ওপরে আত্মসাৎ করেছে। এটা আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটেও ধরা পড়েছে এবং আমরা যে ইন্টারন্যাশনাল অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করেছিলাম সেখানেও ধরা পড়েছে। আমরা মনে করি তাদের হাতে নগদের কার্যক্রম আবার ফেরত যাওয়াটা উচিত নয়। যেহেতু কোর্টের একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা এটাকে আপিল করেছি। শিগিগরই শুনানির ডেট দেয়া হবে। আমরা মনে করি আমাদের পক্ষে রায় পাব। কিন্তু আমরা শঙ্কিত। এই সময়ের মধ্যে তারা তাদের পুরো কন্ট্রোল কিন্তু নিয়ে নিয়েছে সিস্টেমের, যেটার ওপর আমাদের কোনো হাত থাকবে না। কারণ আইনগতভাবে আমরা একটু অসুবিধাজনক অবস্থায় আছি। তিনি বলেন, তারা এই সময় বড় কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি তারা শুধু ক্যাশ ইন ও সেন্ড মানি করতে পারবে। তারা তাদের ডাটাবেজ মুছে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। তারা ডাটাবেজ মুছে ফেলতে পারে। যেটা আমাদের কাজ আরো কঠিন করে তুলবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.